হেরে গেলেন ক্ষিদ্দা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাঙালির শেষ আইকন
সব চেষ্টা ব্যর্থ করে পরলোক গমন কিংবদন্তির। গত ৪০ দিন ধরে বেলভিউ নার্সিং হোমে নিউরোলজি, নেফ্রোলজি, কার্ডিয়োলজি, ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন, আইডি বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের একটি দল আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। তবু কালের নিয়মেই চলে গেলেন কালজয়ী অভিনেতা, বাঙালির শেষ আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
রায়গঞ্জে গভীর রাত পর্যন্ত শোনা গেল শব্দবাজির আওয়াজ
Bengal Live ডেস্কঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়… নাম শুনলেই বাঙালির হৃদয় উদ্বেলিত হয়…শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় আট থেকে আশির। সেই শেষ কিংবদন্তি বাঙালির কালের যাত্রার ধ্বনি বাজলো। অবসান হল একটা যুগের, একটা ইতিহাসের, একটা প্রতিষ্ঠানের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকেই সারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। একে তো বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই, তার ওপর বছরটা ২০২০। সবেতেই যেন অশনি সঙ্কেত। কত কৃতী মানুষ যে চলে গেলেন এই অতিমারির কালে ! আশঙ্কা, উদ্বেগ তাই কিছুতেই কাটছিল না। যদিও অনেকেই আশায় বুক বাঁধছিলেন, এই বুঝি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন। কিন্তু না, আশঙ্কাকে সত্যি করেই আপামর বাঙালির শেষ জীবিত আইকন বিদায় নিলেন বেলাশেষে।
চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রর পিসিমা তারা দেবীর সঙ্গে ‘স্যার’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কলকাতা হাইকোর্টের জাস্টিস রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। সৌমিত্রর পিতা কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। তারপর বাবার চাকরি বদলের কারণে সৌমিত্রর বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং উনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমহার্স্ট স্ট্রীট সিটি কলেজে, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। এই সময় অল্পস্বল্প থিয়েটার করছেন তিনি। এরকমই একদিন তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ীর অভিনয় দেখেন। এরপর তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি শিশির ভাদুড়ীর সাথে পরিচিত হন ও মনে প্রাণে তাঁকে নিজের নাট্যগুরু হিসেবে মেনে নেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ী দ্বারা তিনি দারুণ প্রভাবিত হন। অভিনয়ের আঙ্গিক, উচ্চারণ এসবের খুঁটিনাটি শিক্ষা তিনি তাঁর কাছ থেকে লাভ করেন। মূলত এই সময়পর্বে তিনি রেডিওতে ঘোষক ও থিয়েটারে অভিনয় করে যাচ্ছিলেন।
সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। তিনি একজন খুব উচ্চমানের আবৃত্তিকারও বটে। এক কথায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার এক আদ্যোপান্ত বাঙালি ভদ্রলোক।
সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর প্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়-এর অপুর সংসার ছবিতে(১৯৫৯)। এটি সত্যজিৎ রায়ের পঞ্চম ছবি। এরপর ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাঁকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। সত্যজিৎ রায়-এর দ্বিতীয় শেষ চলচিত্র শাখা প্রশাখা-তেও তিনি অসাধারণ অভিনয় করেন।
কল লেটার হাতে এল ইন্টারভিউয়ের দুই দিন পর, চাকরি হল না রায়গঞ্জের যুবকের
তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তাঁর চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতেন না। ফেলুদা ছাড়াও অপু (অপুর সংসার) , ক্ষিদ্দা ( কোনি) , নরসিংহ ( অভিযান), সন্দীপ ( ঘরে বাইরে), অসীম ( অরণ্যের দিনরাত্রি), অমল (চারুলতা), উদয়ন পন্ডিত ( হীরক রাজার দেশে) এরম অংসখ্য মনিমাণিক্য দিয়ে নির্মিত সব চরিত্র।