কাঠের তৈরি চৌকি ছেড়ে মাটিতেই ঘুমোন পীরপালবাসীরা। খাটে ঘুমোলে স্বপ্নাদেশে তাদের মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয় বলে রয়েছে জনশ্রুতি।
Bengal Live গঙ্গারামপুরঃ কোনও ঐতিহাসিক জায়গাকে ঘিরে বহু জনশ্রুতি প্রচলিত থাকে। তবে ঐতিহাসিক কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ কাঠের তৈরি খাট ছেড়ে মাটিরই তৈরি ঢিপিতে ঘুমোন এই ঘটনা সচরাচর শোনা যায় না। বিগত কয়েকশো বছর ধরে এমনই এক ঘটনার সাক্ষী দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর ব্লকের বেলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের পীরপাল গ্রাম। ইতিহাস ঘেরা জনশ্রুতিতে বিশ্বাসী হয়ে মাটির তৈরি ঢিপিতেই ঘুমোন গ্রামবাসীরা।
তবে ঠিক কি কারণে এই প্রচলন? জেলার ইতিহাসবিদদের কথায় , ১৭০৭ সালে সুলতানি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি পাল বংশের রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সংগ্রামপুর, দেবীকোট সহ সমগ্র গৌড় দখল করেন। লক্ষ্মণ সেন প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে যান তৎকালীন বঙ্গে এবং তার সৈন্যরা পরাজিত হয়ে নদিয়া শহর পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর বখতিয়ার খলজী তিব্বত ও কামরুপ অভিযানে যান। সেখানে বিফল হয়ে তিনি ফিরে আসেন দেবীকোটে।
তিব্বত অভিযান বিফল এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি লখনৌতির মুসলিম রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ সৃষ্টি করে। ফলে বাংলার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দিল্লির সাথে সম্ভাব্য বিরোধে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। আর এই সকল চিন্তা, এবং পরাজয়ের গ্লানিতে অসুস্থ হয়ে পরেন বখতিয়ার খলজি । এবং এর কিছুদিন বাদেই বাংলার ১২০৬ বঙ্গাব্দে ও ইংরেজীর ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন তিনি। ইতিহাসবিদদের অনুমান , বখতিয়ারের খলজীর মৃত্যুর পিছনে হাত ছিল তার প্রধান সেনাপতি আলী মর্দান খলজীর। খলজির মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয় এই পীরপালে।
গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর বখতিয়ার খলজি পীর রূপে আবির্ভূত হন। তাদের দাবি কাঠের তৈরি খাটে ঘুমোলে স্বপ্নাদেশে তাদের মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়। গ্রামবাসী নাটারু রায় জানান, বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে তারা গল্প শুনে আসছেন রাতে চৌকি বা খাটে শুলে স্বপ্নে ঘোড়া ছোটার আওয়াজ পাওয়া যায়। আর তারপরেই সেই পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পরে। তাই তারা কাঠের তৈরি চৌকিতে ঘুমোন না বা কাউকে ঘুমোতেও দেন না।
এই বিষয়ে জেলার ইতিহাসবিদ সমিত ঘোষ বলেন, বীর যোদ্ধা বখতিয়ার খলজীকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গ্রামবাসীরা মাটিতে ঘুমোন। ওই এলাকার মানুষের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে। বখতিয়ার খলজী পীরপালের মাটিতে শায়িত আছেন তাই গ্রামবাসীরা কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে ঘুমোন না। এছাড়াও তিনি বলেন, পীরপাল সহ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এখানে একটা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে নজর দেয়া উচিত সরকারের।
পীর রূপী খলজিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতি বছর বৈশাখ মাসে মেলাও বসে ওই এলাকায়। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেলা দেখতে আসেন বহু মানুষ। কিন্তু বর্তমানে ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পীরের দরগা। সরকার থেকে পর্যটন কেন্দ্র করা হবে বলে আশ্বাস দিলেও তা এখনও পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের।