পোর্টজিন

আলোর বেণু বাজতো যখন…

আলোর বেণু বাজতো যখন…
— সন্দীপ কুমার ঝা

একটা ভোর। কুয়াশার ওড়না গায়ে, রাত জাগানিয়া অলৌকিক ভোর। সবুজ পাতায় শিশির কুচি… উঠোনে খসে পড়া শিউলি ফুল… বুড়ো বটতলা… নদীর কিনার পেরিয়ে কিশোরবেলার সেই ভোর ফিরে দেখলেন সন্দীপ কুমার ঝা।

 

Bengal Live পোর্টজিনঃ জাগো….তুমি জাগো…
জেগেই তো থাকতাম। সারারাত… ! ঘুম আর আসত কোথায় ! মহালয়ার ভোর। গোটা গ্ৰামটাই জেগে থাকত তখন।

‘মেকার’-এর ঘর থেকে চক্কর মেরে এসেছে রেডিওটা, একদিন আগে। পেটের ভেতরে চকচকে দুই জোড়া ব‍্যাটারি নিয়ে সেও তৈরি। সেন্টার ধরার কাঁটাটাও ভোরের অপেক্ষা করেনি। আগের রাত থেকেই সাবধান পজিশনে। ডান দিক, বাঁ দিক, নাকি একটুখানি পূর্ব-পশ্চিম কোণে ঘোরালে ভালো শব্দ ধরে, তার পরীক্ষাও শেষ। কেউ যেন ওকে না ঘোরায় — এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রেডিওটাও অপেক্ষা করত টেবিলের উপরে সেই ভোরটার জন‍্য। শুধু একটা অলৌকিক ভোর ! যে ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলা থেকে দেবীর আগমণী গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে হিমেল বাতাসে।

সকলেই জানত, মাঝরাতে জীমূতদা একবার গ্ৰাম চক্কর দেবে। তাঁর চাদরের তলায় লুকানো থাকবে টেপ রেকর্ডার। ক‍্যাসেটে বাজবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া। সে আওয়াজ পৌঁছে যাবে দরজার সামনে। সময় লক্ষ‍্য না করেই, হুড়মুড়িয়ে রেডিওর নব ঘুরিয়ে হয়রান হবে অনেকে। শেষমেশ বদমায়েশি বুঝে, নিজেরাই হাসতে হাসতে আবার এলিয়ে পড়বে বালিশে। আর একটু সময়ের অপেক্ষা…

উঠোনের গাছটা থেকে একটা…দুটো… শিউলি খসে পড়ল বোধহয়। পেছনে পুকুর। সবুজ কচুরিপানার উপরে ভাসছে চা এর দোকানী সুরেনদার গায়ের ধুতির মত পাতলা কুয়াশা। আমাদের মাটির কোঠা। খড়ের চাল। তখন টুপটাপ এক-দুই ফোটা শিশির চুঁইয়ে পড়ছে উঠোনে। গোবর লেপা উঠোনে, ফোটার শব্দ- টিপ… টিপ…!

সময় হলেই প্রায় এরকমই একটা শব্দ বেজে উঠবে। একটা দুটো টোকা পড়বে বন্ধ জানালার গায়ে। কথা আছে। গীতেশ, সঞ্জয়, মানব, তারক… আরও অনেকের সাথেই কথা ছিল।

কোথাও শঙ্খ বেজে উঠবে। তারপর, একহাতে সাইকেলের বাতিল টায়ার, আর এক হাতে ছোটো লাঠির সঙ্গে আমরাও মিলিয়ে যাব বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে। ধুলোভর্তি গোটা পথটা উড়িয়ে দেব আকাশে। পৌঁছে যাব গ্ৰামের কিনারে। বিরাট মাঠটার ধারে। নদীর ধারে। ক্ষুদিরাম মাষ্টারমশাইয়ের জমির উপরে।
দৌড় লাগাব। দৌড়… দৌড়… দৌড়…! অকারণ…

এক চক্কর দৌড়ে, ফিরে আসব চণ্ডী মণ্ডপে। দুর্গার কাঠামোর গায়ে তখন কতকটা মাটি। কচি কচি মুলো গাছের গায়ে জমে থাকা হীরের কুচি, ফুলকপির চারাতে তখন মোমের মতো আদর। আমাদের পায়ে পায়ে জমির আলপথ থেকে তারাও উঠে আসবে।

সেখান থেকে বুড়ো বটতলা পেরিয়ে আবার নদী। স্নানের ঘাট ছেড়ে, খাড়া উঁচু পাড় বেয়ে হাঁটুজলে। আঁজলা ভরা জল। হাত মুখ ধুয়ে নেওয়া ঠান্ডার সর মাখা জলে।

কথা ছিল, এরপর নদীর ধারে বালুচরের উপরে, সাইকেলের টায়ারগুলোতে আগুন জ্বালাব। কথা ছিল-মানব দেশলাই আনবে, আর নিখিল আনবে কেরোসিন। ঘরে ফিরবো যখন, তখন আমাদের কানে লেগে থাকবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ছোঁয়া। হাতে পায়ে স্বর্গীয় ধুলো আর বুকের ভিতরে কচি কাশফুল!

কথা ছিল !
কথা তো কতই থাকে, কিন্তু কথা থাকে কই !

আজকেও একটা মহালয়ার ভোর ! মায়ের চলে যাওয়ার পরে, আর কেউ রেডিওটা ঠিক করেনি। আজকেও কাঁচের জানলাটা খুলে রেখেছি। যদি ভেসে আসে-“জাগো…তুমি জাগো..”

টিভির পর্দায় মিমি অথবা হেমামালিনীরা নাচছে! ডি.জে. বাজছে মোড়ের মাথায়।

ছেলেটা পাবজি খেলে একটু আগেই ঘুমিয়েছে। ও আর এখন জাগবে না!

আমি শুধু এখনও বসে আছি সেই নদীটার পাশে। আমার পাশে সাইকেলের টায়ার। বেতবন, হরিতকির বন পেরিয়ে এখনো ছুটে যাচ্ছি। ছুটে আসছি আমার কাছেই। পাশে পাশে ছুটছে সেই অলৌকিক ভোর ! জাগো…তুমি জাগো…

Related News

Back to top button