পোর্টজিন
“পাওয়া” লিখেছেন কৌশিক পাল
Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।
আমার নাম অর্চনা। বয়স চব্বিশে পা দিলাম এই একমাস হল। কাজ বলতে ঘরের যতটুকু। বাবার হোটেলে খেতে হয় এখনো। টুকটাক লেখার শখ আমার ছোটবেলা থেকেই। ঠাকুরমা বেঁচে আছেন এখনো। জোয়ানদের মতো শক্তি এখনো গায়ে। পঁচাশি পার হলে কী হবে, এখনো নিজের সব কাজ নিজে করে। শুধু একটু-আধটু ভারী কাজের সময় আমাকে ডাকে।বলে,-“বুড়ি, ও বুড়ি একটু এদিকে আয় তো, ট্রাঙ্কটা একটু ধর তো।” ব্যাস! ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেই নানানরকমের কাজ ঠাকুরমার। এদিকে সকাল আটটা-নটাতে উঠেও আমার কোনো কাজই নেই। সব মিলিয়ে একটা হাসিখুশি বাড়ি আমাদের। আর আমি ঠাম্মিকে দেখে একটা আলাদাই উৎসাহ পাই। খুব ভালোবাসি মানুষটাকে, সাথে আরেকজনকেউ; সে আমার প্রেমিক। এক বছর হল এম.এ-টা পাশ করেছে বেচারা।
সে বেচারাই। তাছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না আপাতত। যেমনটা ভালোবাসি, ঠিক তেমনটাই মায়াও হয়। সিগারেট খায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমিই কিনে একটা হাতে ধরিয়ে দি। আর কী বা মনে হবে তাছাড়া! মাঝে মাঝে এত চিন্তায় থাকে ও —- আমি ওর জায়গায় থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যেতাম, নয়তো সুইসাইড বা অন্যকিছু!
ও ঠিক আমার ঠাম্মির মতো; ভেতর থেকে খুব শক্ত মনের মানুষ। ও মানে অঙ্কন, ওর বাবাকে খুব ভয় পায় এখনো। ওদের একটা ছোট ব্যবসা আছে। মা মাধ্যমিকের পরই মারা যায় হঠাৎই। হয়তো স্ট্রোক বা এজাতীয় কিছু একটা হয়েছিল; আমি এ ব্যাপারে অঙ্কনের সাথে কথা বলি না। মায়ের ব্যাপার, কষ্টটা বেশি পাবে হয়তো।
বড়ই আনমনা ছেলে। আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক। আজ পর্যন্ত একদিনও আমাকে ছোঁয়ার জন্য বায়না করেনি, অথচ একটা বন্ধুর মতো সারাক্ষণ আমার সাথে থাকে। কলেজে পড়তে কতবার আমাদের বাড়ি গেছে, এমনকী দু-তিনমাস আগে পর্যন্ত গিয়েছে, তবু এতটুকু ওর চরিত্রের সংযম ক্ষমতা হারায়নি। যেটা আমার খুবই ভালো লাগে, স্নেহ হয়, ভালোবাসা বাড়ে বই কমে না। ও বিয়ের আগে আমার সাথে কোনোরকম শারীরিক সম্পর্ক করবে না। খুব ভালোবাসি আমি অঙ্কনকে।
অঙ্কনের বাবার বয়স বাড়ছে, সাথে অঙ্কনেরও, আমারও। বাড়িতে আমার বাবা-মা না বললেও মুখ দেখলেই বিয়ের ব্যাপারটা বোঝা যায়। অঙ্কনকে বলেছি একবার, তবে এখন আর বলি না কিছু। জানি, সে’ও খুব চিন্তায় আছে। বুঝি যে ওর, বাবার একটা চিন্তা, সংসারের হাল ধরতে হবে, তারপর আমি, আমার পরিবারকে মানানো—সব মিলিয়ে একটা কঠিন দুর্বিসহ বেড়াজালের মধ্যে রয়েছে ও।
এখন আর ও, ফোন করে ডাকে না আমাকে, বরং আমিই ওকে বলি,-” আজ আয় না রে অঙ্কন, অনেকদিন দুটো কথা হয় না তোর সাথে; তোর অগোছালো মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে!”
ও ‘না’ করতো না। একটা পাঞ্জাবি আর প্যান্ট পরে চলে আসতো নদীর ধারে। ওউ যে খুব ভালোবাসে আমাকে, পাগলের মতো! শুধু প্রকাশ করে না তেমন।
সেদিন নদীর পাড়ে এসে আমার ঠাম্মির হাতের বানানো চিঁড়ের নাড়ু ব্যাগ থেকে বের করে দিলাম অঙ্কনকে। ওর খুব প্রিয় আমার ঠাম্মির হাতের নাড়ু। সেদিন ও নাড়ুটা হাতে নিয়ে এক কামড় দিয়ে এমন থমকে চেয়ে থাকলো নদীর দিকে যে, দেখলে যে কেউ কেঁদে ফেলবে! আমি চোখের জলটা মুছে বললাম-“নাড়ুটা ভালো হয়নি না রে অঙ্কন?” ও কিছুই বলল না। আবার বললাম কাঁদো গলায়, “বল না রে অঙ্কন কী হয়েছে, আমায় বলবি না? পর ভাবিস না রে আমায়?”
কথাটা বলার পরই অঙ্কন বিদ্যুতের বেগে কেঁদে আছড়ে পরলো আমার কোলে। জানি না কত বছর, তবে মনে হয় কয়েকশ বছরের জলকে আটকে রেখেছিল ও চোখে। বাড়ির চাতাল ডোবা বৃষ্টির মতো অঝোরে কাঁদতে লাগলো আমার প্রিয় মানুষটা। পুরুষের কান্না নাকি ডুমুরের ফুল, কয়েক মিনিটের জন্য বুঝতেই পারলাম না বোধ হয়!
সেদিন দুজনেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। রাতের খাওয়া সেরে গল্পের বইটা পড়ছি। যে সময় কোনো কোনো দিন আমি আর অঙ্কন ফোনে কথা বলা শেষ করে ঘুমোই, ঠিক সে সময় অঙ্কনের ফোন আসলো। বইটা বন্ধ করে ফোনটা ধরেই বললাম-‘বল?’
উদাসীন গলায় অঙ্কন বললো,”একটা খুন বা ডাকাতি বা অপহরণ বা রেপ করলে কেমন হয় বলতো?” আমি একটু উত্তেজনা ও প্রায় জোরেই বলে উঠলাম,”কী বলছিস এসব তুই অঙ্কন?”
ও বললো, “আরে না রে, জেলে গেলে মাথার উপরের ছাদ আর পেটের ভাত বা রুটিটা তো অন্তত পাওয়া যাবে! হ্যাঁ রে আমি শুনেছি, আমাদের কলেজের অমিতের পিসতুতো ভাইটা, ও তো ডাকাতির কেসে যাবৎজীবন কারাদন্ড। এখন ও পাগল হয়ে গেছে। ওর মাথায় ছাদ আর পেটে ভাত দুটোই আছে রে।” আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পরে যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছিলাম না। ফোনের ওদিক থেকে আবার শোনা গেল,”অর্চনা, এই অর্চনা শুনতে পাচ্ছিস? আমাকে ভুলে যান না কিন্তু, জেলে দেখা করতে আসিস মাঝে মাঝে!”
ব্যাস, ফোনটা কেটে গেল। দেখি ফট করে মা ঘরে চলে এসে ডাকছে,-“কী রে মেয়ে লাইটটা নিভিয়ে ঘুমাবি তো? বই মুখের উপর খুলে রেখে ঘুমোচ্ছে! নে এবার ঠিক করে ঘুমো।” পরে বুঝলাম স্বপ্ন ছিল। আর তখন থেকে আমাকে অঙ্কনের জন্য ভীষণভাবে একটা চিন্তা জড়িয়ে ধরতে শুরু করলো। তারপর আবার কখন যে ঘুমিয়েছি, জানি না।
পরদিন সকাল নটা নাগাদ টেবিলের উপর রাখা ফোনটা বেজে উঠলো, দেখি অঙ্কন ফোন করেছে। একটা চিন্তা হলো বেশ। প্রচন্ড ভয়ে ফোনটা ধরলাম। ধরতেই, ওপার থেকে শুনি অঙ্কনের গলা, আনন্দের বিস্ফোরণের মতো ফেটে ছেলে বললো-“অর্চনা আমার চাকরিটা হয়ে গেছে, এক্ষুনি মেলটা এলো। বাবাকে প্রথম জানানোর পর তোকেই ফোনটা করলাম। রাখি হ্যাঁ, পরে দুপুরে দেখা করবো কেমন!” ব্যাস, বলেই ছেলে খালাস। আমাকে কিছুই বলতে দিল না ছেলেটা; কিন্তু সেই হঠাৎ সকালটায় কী যে একটা শান্তির অনুভুতি হচ্ছিল, তা বলে বোঝাতে আমি অক্ষম। মনে হল যেন অনেকটা তপ্ত বালি ও মরীচিকার পর একটা জীবন্ত মরুদ্যানের সন্ধান পেলাম। একটা নতুন জীবনের সুর খুঁজে পেলাম, আর মনে মনে বললাম,” এভাবেই যেন পাড়ে আছড়ে পড়ে, মাঝ সমুদ্রের প্রতিটা জল।”
কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9635459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।