একটি প্রণাম মহাপৃথিবীর পথে পথে — অনিমেষ মণ্ডল
একটি প্রণাম মহাপৃথিবীর পথে পথে
— অনিমেষ মণ্ডল
Bengal Live পোর্টজিনঃ
তুমি ঈশ্বরকন্যা,তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে/ ব্যাক্তিগত মৌলিক দৃশ্য থেকে ধূসর বিষয় নিয়ে আমি,ব্যক্ত অব্যক্তের /অবাস্তব মুহূর্তের স্বতন্ত্র আমি,আমার গভীরতর সাম্রাজ্যে/তুমি আছো,তুমি নেই/তোমার আশ্চর্য হবার মতো বিশুদ্ধ প্রীতি,কৃত্রিম পদ্ধতিতে আকাশে/ ওড়ার ব্যাপারে তুমি বয়সে প্রবীণ/তুমি ঈশ্বরকন্যা,অত মেহনত ও অর্থব্যয় পণ্ড করে কেন ভেসে যাবে ….
ব্যক্তি শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কবি শম্ভু রক্ষিতের বিশেষ কোনো তফাৎ নেই।দুটো জীবনই বেপরোয়া।তাঁর নিজের জীবনযাত্রা যেমন তাঁর একান্তই নিজের তেমনি কবিতাও তাঁর একেবারে স্বতন্ত্র।তিনি বিশ্বাস করেন কবির ভিতর বাহির অপাঙ্ক্তেয়।সন্ধান যা করার তা করতে হবে তাঁর সৃষ্টি সমগ্রে।যা হবে একেবারেই মৌলিক।
কবি রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরি এক জায়গায় বলছেন “তিনি সর্বদাই অভিনব উদ্ভাবনে সচেষ্ট।কখনো হয়তো অনেকের কাছে তাঁর এসব পরীক্ষা অদ্ভুত ঠেকে,কিন্তু এই অদ্ভুতের সঙ্গে কাব্যরসের যে মিশ্রণ ঘটে তা অলৌকিক।”
উপরোক্ত কবিতার পংক্তি থেকে আমরা দেখতে পাই ঈশ্বরকন্যার কাছে তিনি বিশুদ্ধ কবিতার জনক হতে শিখেছিলেন।কবিতাশিল্পে নিমগ্ন হবার সেই শুরুর দিনগুলিতে তিনি বিশুদ্ধপ্রীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।শিল্পের সেই নিগূঢ় অন্তর্লোককে তিনি সহজেই চিনতে পেরেছিলেন। কৃত্রিম কৌশলে আকাশে ওড়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছিলেন যাতে সেই ঈশ্বরকন্যার সাম্রাজ্যে পৌঁছানো যায়।এবং তিনি তা পেরেছেন।তাই তিনি তাঁর সচেতন নির্মাণদক্ষতা দিয়ে রচনা করলেন অশ্রুতপূর্ব সব কবিতা।
সমুদ্রের নিচে বালুকণারা পাহারায় পাহারায় নিরাশ হয়ে গেছে/ একদা এই ভেবে অন্যমনস্কের অতিকায় জোরে জেগে ওঠে এক দারু দেবদূত/ এবং ওইরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় বহুদিন/ নিখিলের মহাপ্রতীক্ষা,রাত্রি খেই ধরে দুস্তর পিপাসার কাছে/ বিস্ময়ে-ভরা স্বল্প কয়েকটি বিবরণ যেন শুয়ে আছে সব অবসানের পাশে ……
অলৌকিক এক মেধা এবং আশ্চর্য এক প্রেরণা থেকে তিনি একের পর এক বাক্য গঠন করে গেছেন।তিনি বলছেন তাঁর কবিতার বয়স বা চরিত্র নেই।আছে শুধু ভার বা ওজন।কী সাংঘাতিক কথা বলছেন তিনি।
আর দশটা গড়পড়তা মানুষ যেভাবে জীবনধারণ করেন তিনি তা কখনই করেননি।তিনি মনে করেছেন তাঁর চাকরিবাকরির কোনও দরকার নেই তাই তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ হয়ে ওঠবারও প্রয়োজন নেই।তাই তিনি চিরকাল গ্রামে বাস করে গেলেন ।সম্বল বলতে ছিল দেড়তলা একটি মাটির বাড়ি।ঠিকানা বিরিঞ্চিবেড়িয়া,পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর,পূর্ব মেদিনীপুর।যদিও এই ঠিকানা এখন আর তাৎপর্যরহিত।কেননা তিনি এখন মহাপৃথিবীর পথে।
একটি ছোট কোণাভাঙা মার্বেলফলক দেওয়ালে সাঁটা।তাতে লেখা মহাপৃথিবী।এই মহাপৃথিবী থেকে বাস্তবিক মহাপৃথিবীর পথে । 1970 সাল থেকে তিনি মহাপৃথিবী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ।1975 এর জরুরী অবস্থার সময় সাত মাস জেল খেটেছেন।
প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।এই বই বাংলা কবিতার পাঠককে একেবারে হতবাক করে দিল।বইটিকে সবাই নিতে পারলেন না।কেউ কেউ এড়িয়ে গেলেন প্রলাপ মনে করে।কিন্তু তিনি বৃহত্তর এক পাঠকসমাজের সমীহ আদায় করে নিলেন।অথচ কবি শম্ভু রক্ষিত রয়ে গেলেন এক অজ্ঞাত নীরবতার আড়ালে।কারণ সেটাই যে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গি।কিন্তু তাঁর অতলস্পর্শী হৃদয় ভেদ করে চারদিকে অক্ষরের জ্যোতি বেরতে লাগল।একটা অস্ফুট কান্নার ধ্বনি আমাদের মর্মমূলে আঘাত করল।কতটা নৈরাজ্যবাদী হলে এরকম কবিতা লেখা সম্ভব তা শম্ভু রক্ষিতকে না দেখলে বোঝা যাবে না।কিন্তু কেউ কেউ তাকে অ্যাবসার্ড কবিতা বলে রয়ে গেলেন দূরে।
তিনি কোনো জীবিকা গ্রহণ করলেন না।সারাজীবনটাই
অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দিলেন।তাঁর মলিন পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মানুষটির গভীরতার স্পর্শ পাওয়া ভার।কেননা তাঁর কবিসত্তাকে কোনও মালিন্য স্পর্শ করতে পারেনি।নিজের অবস্থার জন্য তিনি কখনো কারুর কাছে বিলাপ করেননি।কখনো সাহায্যের আবেদন জানিয়ে হাত পাতেননি কারুর কাছে ।এতটাই তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ।সেই আত্মমর্যাদাবোধ নিয়েই আজ সকালে তিনি চলে গেলেন শাশ্বত কালের ডাকে সাড়া দিয়ে।
“আমি আমার জন্য নতজানু হই না,আমি চাই উন্মোচন
আমি প্রকৃতির জন্যে যেন নিরপরাধ এবং শান্তভাবে বিচরণ করতে পারি।”