Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।
১. চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতায় এক স্বতন্ত্র স্বরকে তুলে ধরলেন কবি অরুণ ভট্টাচার্য।সমাজ বাস্তবতা,রাজনীতির জটিল আবর্ত,যুদ্ধ,মন্বন্তর,দেশভাগের মত মর্মন্তুদ ঘটনার আবর্তে বাংলা কবিতা আবর্তিত হচ্ছে,একদল তরুণ তুর্কি যখন কবিতাকে ক্রমাগত করে তুলতে চাইছেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার;সেই জায়গা থেকে দূরে সরে এসে অরুণ ভট্টাচার্য কবিতার মধ্যে সন্ধান করতে চাইলেন এক আত্ম উত্তরণের পথরেখা।তাঁর অন্বেষ্য একটা স্বচ্ছ অনির্বাণ আলো,যা তাঁর জীবন ও যাপনের ক্লান্তি,জড়তা,ক্লীবতা ঘুচিয়ে দিয়ে আনবে এক পরমা প্রশান্তি।তাঁর বলার ভঙ্গি নম্র মাধুর্যে ভরা।অনাবিল ও নির্মেদ তাঁর ভাষা।তিনি নিজেই বলেছেন যে: জীবনকে আমি সরলতায় রূপান্তরিত দেখতে পেলে খুশি হই।আমার কবিতাকে সেইভাবেই সাজাবার চেষ্টা করি।(‘কবিতা ভাবনা’ :উত্তরসূরি,শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৪৮)
কবি অরুণ কুমার সরকার তাঁর সম্বন্ধে লিখছেন যে : প্রাথমিক উত্তেজনার শেষে দেখতে পাচ্ছি চল্লিশের কবিতায় যে যাঁর নিজের ঘরে ফিরে এসেছে,নিজের ভাষায় কথা বলছেন।গীতিকবিতার পুনরুজ্জীবন,কেমন একটা মধুর ক্লান্তি,একটা মধুর বিষণ্নতার ছায়া নেমে এসেছে তাঁদের রচনায়।বহির্বিশ্বকে তার আর অর্জিত ধারণার চশমা দিয়ে দেখছেন না,দেখলেন নিজের চোখ দিয়ে।(‘চল্লিশের চোখে চল্লিশের কবিতা’)
“শেষ ট্রেন মুহূর্তে ছেড়ে গেল।প্লার্টফর্মে/আমি বসে রইলুম।নিবিড়/আকাশে দূর নক্ষত্র দেখা গেল।/এমনি নক্ষত্র দেখা যায়।নির্জন আকাশতলে/আরো নিঃসঙ্গ প্লার্টফর্মে/শেষ ট্রেন চলে গেলে পর/বিশ্ব ভুবন স্তব্ধতায় জেগে ওঠে।”(‘বিশ্বভুবন স্তব্ধতায় জেগে ওঠে’)
প্লার্টফর্ম থেকে রাত্রের শেষ ট্রেন চলে যাবার পর চারিদিকের কোলাহল স্তব্ধ হয়।ঘনীভূত হয় নিস্তব্ধতা ও অসন্নতা।এই প্লার্টফর্ম আসলে জীবনেরই প্রতীক।যেখানে নানাসময়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে আসা যাওয়া করে।’আমি’ অর্থাৎ কবি কোন ট্রেন ধরতে পারেননি বা ধরতে চাননি।তিনি শুধু দ্রষ্টার মত বসে দেখছেন সব কিছু।তিনি ভিড়ের মধ্যে মিশতে চাননি,হতে চেয়েছেন একাকী;বিশ্বভুবনের অপার্থিব স্তব্ধ সৌন্দর্য অবলোকন করছেন শুধু।
কোন আক্ষেপ বা যন্ত্রণা নেই;তিনি খুঁজছেন অপাপবিদ্ধ,নির্মল ও শাশ্বত এক পরিসর যেখানে তিনি পেতে পারেন আত্মিক মুক্তি।যা তিনি খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতির মধ্যেই –
“এইসব মুহূর্তগুলি আমাদের কোথাও টানে,/আমার ভিতর দ্রিমি দ্রিমি মেঘের ডাক।/আকাশ যেন কান পেতে শোনে।”(‘এই মুহূর্তে,স্থবিরতা’)প্রকৃতির সাড়া তিনি অনুভব করছেন নিজের অস্তিত্বের মধ্যে।
প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্যে বা লোকসাহিত্যতে ‘নৌকা’ কে একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।সমুদ্র বা নদী হল সেই অশান্ত সংসার যা পার করার জন্য দরকার কোন অবলম্বন তা গুরুর কৃপা বা ঈশ্বরের নাম যা কিছু হতে পারে।তাকেই নৌকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।কবি এখানে এই নৌকার ও মাঝির রূপকল্পকে ব্যবহার করলেন।তাঁরও উদ্দেশ্য এই সংসারের অবিলতাকে অতিক্রম করে এমন এক লোকে পৌঁছানো যেখানে আছে শুধু অপার আনন্দ।কবি লিখছেন যে:”তাই নদীর তীরে বাঁধা নৌকার গলুইতে বসে/মাঝিকে বললো,আমাকে পৌঁছে দাও/সেই অনুকূলে/যেখান থেকে আর ঘরে ফিরতে হবে না কখনো।”(‘শেষ চিঠির উত্তরে’)।তিনি এখানে একটি সিদ্ধ রূপকল্পকে ভেঙেছেন।রবীন্দ্রনাথের একাধিক লেখায় যে অনুষঙ্গ একাধিক বার পাই।
২. তিরিশের দশক থেকেই যখন বেশিরভাগ কবিরা প্রেম,প্রকৃতি ও রোমান্টিক মাধুরীর রম্য পরিসর ছেড়ে ঝুঁকছেন সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার উগ্র, নির্মম দিকগুলির প্রতি ,সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অরুণ ভট্টাচার্য এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম।তিনি বারংবার পরমা প্রশান্তি খুঁজছেন সেই প্রকৃতি তন্ময়তা ও অস্তিক্য বোধের মধ্যে ডুবে।তাঁর তিনটি কবিতার অংশকে এক্ষেত্রে তুলে ধরব-
ক.”নদীর ধারে বুড়ী অশ্বত্থ গাছের শাখায়/পাখিটাকে বসে থাকতে দেখেছি।/দেখে ডাকলুম, আয় কাছে আয়।”(‘শেষ চিঠির উত্তরে’)
খ.”সমুদ্র,তুমি কাছে এসো/আমার বুকের ঢেউগুলিকে/শান্ত করে দাও।”(‘সমুদ্র কাছে এসো’)
গ.”আমি গভীর গভীর তর রাত্রি জেগে/শুকতারার প্রতীক্ষায় আছি।…”(‘প্রহর গুনছিলাম’)
তিনটি কবিতাংশের মধ্যেই নিহিত একটা সুন্দর শান্তশ্রী।বিক্ষোভ,বিদ্বেষ,হতাশাকে ভুলে প্রকৃতির মধ্যে লীন হতে চাইছেন এক অনাবিল স্নিগ্ধতার আশায়।শেষ কবিতাংশে প্রতিফলিত হয়েছে পেলব রোমান্টিক উচ্চারণ-‘আমি’ অর্থাৎ কবি প্রতীক্ষা রত গভীর রাত্রি পার হয়ে সেই শুকতারার জন্য।লক্ষ করার বিষয় কবি সন্ধ্যা তারা লিখলেন না লিখলেন শুকতারা।যার মধ্যে আছে ক্লান্তি কিন্তু উগ্রতাহীন প্রসন্নতা।কিন্তু সন্ধ্যাতারার মধ্যে রয়েছে এক ঔজ্জ্বল্য,ঘন আবেদন।
৩. যে কোন রোমান্টিক কবি মানসের একটি চিরন্তন দিক হল প্রেম ও বিচ্ছেদের আক্ষেপ ও সুগভীর বেদনাবোধ।তাঁর অসমাপ্ত কবিতাগুচ্ছের দু’টি কবিতা যথা :
ক.”তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।/আমি তাঁর সামনে।/আমরা উভয়েই দাঁড়িয়ে পড়লুম,এক মুহূর্ত কেবল।/আবার দুজনে/যেমন যাচ্ছিলাম তেমনি/দুদিকে চলতে থাকলাম।/আমরা বোধহয় কেউ কাউকেই চিনতে পারিনি।”(‘মিলনহীনতার দুঃখ’)
খ.”তবু কেমন মনে হলো/তিনি যেন বলছেন সবাইকে/সারাজীবন তোমরা আমাকে চেনোনি/চিনতে চাওনি।/এবার থেকে প্রতি মুহূর্তে/আমাকে চিনতে পারবে।যাবার সময় রইলো/এই আমার আশীর্বাদ।”(‘মিলনের শুভ আনন্দ’)
প্রথম কবিতাতে লক্ষণীয় যে,তিনি ‘তুমি’ নয় ব্যবহার করছেন ‘তিনি’ অর্থাৎ সম্বোধনে আপনি।একে অপরের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও চিনতে না পারেনি কেউ কাউকে।কারুর প্রতি প্রেম প্রকাশ করতে না পারার অব্যক্ত বেদনা যেমন আছে তেমনি কবি এটিও কি বোঝাতে চাইলেন না সেই প্রেম জন্মান্তরের।যার স্মরণানুরাগটুকু থেকে গেছে শুধু কবি মানসে?
আবার দ্বিতীয় কবিতাতে তিনি সেই প্রেমাস্পদের বয়ানে পাচ্ছি যে,তাঁকে চিনতে না পারার আক্ষেপ।তবু তিনি আশাবাদী একদিন সবাই তাঁকে চিনতে পারবে।কিন্তু কেন আশীর্বাদের প্রসঙ্গ শেষে এল সেটা বোঝার উপায় নেই;কারণ প্রেমের কবিতায় কেউ কাউকে আশীর্বাদ করছে সেটা বেমানান।কাজেই দ্বিতীয় অংশটি কবিতা হিসাবে যথেষ্টই দুর্বল।
কবি কখন কখন হয়েছেন অবচেতন মনের পর্যটক।এই সমস্ত কবিতাগুলি শৈল্পিক দ্যুতিযুক্ত।যেমন-
ক. “তুমি যখন ঘুমের ঘোরে চাঁদের /বুড়িটাকে ডাকলে কাছে,আকাশ/নেমে আসলো রুপোর সিঁড়ি বেয়ে-/মুখে তোমার জয়ের স্মৃতিচিহ্ন।…”(‘বক্কর জন্মদিন’,ব্লেকের ছবি)
খ.”এই শিশু জামরুল গাছটিকে আমি/দীর্ঘকাল থেকে জানি।চিনি এর স্নায়ু চিনি প্রতিটি শিকড়,/তার অন্তর্গত গূঢ় রস লতাপাতা,পাতার শিহর/বৃষ্টিতে,বৈশাখে,শীতে অথবা ফাল্গুনে/চিরসুখী আনন্দিত বিভা।”(‘জেনেছি আবহমান’)
‘চাঁদের বুড়ি’,’রূপোর সিঁড়ি’ মত মিথিকক্যাল ইমেজগুলো অভ্রান্তভাবে চিহ্নিত করে মানবমনের অবচেতন বা নির্জ্ঞান স্তরকে।পূর্ব জন্মের স্মৃতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে প্রেয়সীর মুখে-‘মুখে তোমার জয়ের স্মৃতিচিহ্ন’।
একটি শিশু জামরুল গাছের সঙ্গে তিনি অনুভব করছেন নিজের একাত্মতা।কবির বিশ্বাস পূর্ব জন্মে এই গাছটি আসলে ছিলেন তিনিই।যা রবীন্দ্রনাথের ‘বলাই’ গল্পটি স্মরণ করিয়ে দেয়।নস্টালজিয়া,জন্মান্তরে বিশ্বাস রোমান্টিক কবিদের অন্যতম চিহ্নায়ক।
৪. কবি তাঁর নিজের সম্পাদিত ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকায় নিজের কবিতা ভাবনা সম্বন্ধে শ্রাবণ-আশ্বিন,১৩৪৮ সংখ্যায় লিখছেন যে-
সেই বস্তুটি মনে হয় Vision, যে Vision মিস্টিক সাধকেরা দেখে থাকেন।রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনদেবতা’ কল্পনায় যাকে দেখেছেন,ইয়েটস দেখতেন,আমার ও দেখতে ইচ্ছে করে।কবি,শিল্পী,ভাবুক বা রসিক তো এই ভিশন নিয়েই বেঁচে থাকেন।অচিন্ত্যকুমার যে রামকৃষ্ণদেবকে ‘কবি’ বলেছেন,আমার তো মনে হয়েছে তিনি মা কালী মূর্তির এই একটি ভাবঘন ভিশন সর্বদাই প্রত্যক্ষ করতেন বলে।পরবর্তীকালে আমি ক্রমাগত চেষ্টাকৃত কবিতা রচনার হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি-বসে থেকেছি অনুরূপ ভিশনের অপেক্ষায়।
কবিতা নিয়ে এমন বিশুদ্ধ অনুভব অনেকাংশে কবি আলোক সরকারের কথা মনে করিয়ে দেয়।কবিতা বা শিল্পকে হাতিয়ার করে কবি আত্ম-উন্মোচনের পথে যেতে চেয়েছেন।তাঁর সৃজনের ভুবন জুড়ে তাই অপার্থিব আধ্যাত্মিক প্রভা।যিনি সমস্ত পার্থিব বাসনা মুক্ত হতে হতে এক প্রকার আত্ম সন্ন্যাসের পথে অগ্রসর হন তাঁর প্রথম লক্ষ্য হল চিরশান্তি।কবি লিখছেন যে-
“ঘুমোইনি।আমি/সব আবোল তাবোল ভেবেছি,রাত্রিবেলা/বারান্দায় পায়চারী করতে করতে/কত সময় বৃক্ষ হতে চেয়েছি যদি শান্তি পাই,/নদী হতে চেয়েছি,যদি যৌবনবতী হতে পারি,/এমনকি প্রেতযোনিতেও থাকতে চেয়েছি যদি/দেহ এবং দেহের যন্ত্রণা থেকে/মুক্তি পেতে পারি।”(‘প্রিয়তম শব্দ ঘুম’)
লক্ষণীয় যে কবিতার শেষে তিনি শুধু শান্তি নয় চাইলেন মুক্তি।তবে সেই মুক্তি তিনি অন্বেষণ করেছেন সেই বিশ্বপ্রকৃতির অনাবিল শুদ্ধতার মধ্যেই।গাছ,নদী,আলো,বায়ু যেমন সবকিছু উজাড় করে দেয় তিনিও তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করে দিতে চান।রাখতে চান না কোন লঘু-চপল পার্থিব বিলাস।রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন যে-আমার মুক্তি আলোয় আলোয় সেই আকাশে/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।’
অরুণ ভট্টাচার্য একজন আদ্যন্ত আধ্যাত্মিক কবি।রবীন্দ্রনাথ,অমিয় চক্রবর্তী , আলোক সরকার,আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখ কবিদের লেখাতেও আধ্যাত্মিক অনুভব যে বৈচিত্র্য ও নানান রূপ,রস ও রঙ নিয়ে ব্যাপ্ত হয়েছে তা কিন্তু অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় এতটা ধরা পড়ে না।কিন্তু তাঁর কবি সত্তাকে আতস কাঁচের নিচে রাখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে,তিনি ধাতু প্রকৃতিতে গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক মননযুক্ত।তাঁর স্বাতন্ত্র্যতা পরিলক্ষিত হয় সেখানেই।এক অস্থির ভাঙাচোরা মূল্যবোধ বিযুক্ত রক্তাক্ত সময় থেকে তিনি উত্তরণ চেয়েছেন,যেতে চেয়েছেন ‘পরিপূর্ণ চৈতন্যের সাগরসঙ্গমে’ ।তাঁর কথায়-
“অধ্যাত্মের জ্যোতির্ধামে/যেখানে নিরন্ত কাল অন্তর প্রদীপ হবে/পরমের প্রসন্ন অরতি।”(‘উত্তরণ’)
কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9635459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।