সুমন ব্যানার্জির লেখা প্রবন্ধ “মণীন্দ্র গুপ্ত’র গদ্য ‘অক্ষয় মালবেরি’ এক আত্মনগ্নায়নের আয়না”

Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।

 

১. মণীন্দ্র গুপ্ত’র কিংবদন্তিতুল্য গ্রন্থ ”অক্ষয় মালবেরি” গদ্যের নাকি কবিতার বই ? ফরাসি সাহিত্যে গদ্য ও কবিতার দ্বন্দ্ব এক বিরাট শৈল্পিক ও মননশীল আন্দোলনকে তৈরি করেছিল।সিসৃক্ষু কবি মন চায় প্রচলিত অনুশাসনের গণ্ডিকে ভেঙে শিল্পসত্তাকে উন্মুক্ত করতে।ফরাসি ভাবুক মারমঁতল লিখেছিলেন যে – পদ্য যদি তার একঘেঁয়ে ছন্দ ভেঙে দিয়ে গদ্যের মুক্ত সুর সঙ্গতিকে আশ্রয় করে তাহলেই সে বাঁচতে পারে।গদ্যের মধ্যে কবিতাকে অন্তঃস্যূত রাখেন অনেক মহৎ স্রষ্টাই।যেমন মণীন্দ্র গুপ্ত’র এই বই।এটা কখনোই উপন্যাস নয়। আত্মজীবনী। একজন কবির ব্যক্তিগত জীবন প্রবাহকে আমরা স্পর্শ করতে পারি।অজস্র ধূলিধূসরিত প্রত্নস্মৃতির চিহ্ন বহন করছে এই বই।এক অত্যাশ্চর্য পরাবাস্তবতার জগত তিনি নির্মাণ করেছেন।
 
      আমরা এই গ্রন্থের প্রথম কয়েকটি অংশ এই প্রবন্ধে আলোচনার জন্য নির্বাচন করেছি।এই শৈশবপুরাণে পাই প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় মিথস্ক্রিয়া,নাগরিক জীবনের প্রচন্ড ব্যস্ততা, দাপট থেকে বহু দূরে নিস্তরঙ্গ,মন্থর পল্লি গ্রামের মাধুর্য , দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, কীটপতঙ্গ, অরণ্য, মন্দির,পুকুর, চণ্ডীমণ্ডপ, ঠাকুমা ঠাকুর্দা আরও কত কী ! তন্তুতে তন্তুতে জড়ানো আছে মায়াবী রহস্যময়তা।নিসর্গের অফুরন্ত প্রাণময়তায় উদ্বেল হয়ে ওঠে এই চরিত্রগুলি।আদিম জীবনের প্রতি লুব্ধতা,অন্তর্লীন হবার ইচ্ছা ফুটে উঠেছে লেখাগুলিতে। তাঁর “লাল স্কুলবাড়ি” কাব্যের ‘কোথায় যায়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন যে – “গোয়ালঘরের গন্ধ,ভাত রান্নার গন্ধ,বাঁশঝাড়ের গন্ধ –/ এইসব সাবেক গন্ধ নিয়ে জড়িয়ে আছে দিন।” 

    অক্ষর মালবেরি বহু রেখার বিভঙ্গে চিত্রিত একটি চিত্রশালা। যেখানে তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে থাকা ‘সাবেক গন্ধ’-র সুলুক সন্ধান পাই।এটি একই সঙ্গে তাঁর শৈশব ও আত্মপুরাণ দুইই। তাঁর শিল্প মানসের অন্তরঙ্গ বৃত্তে প্রবেশ করতে হলে এই গ্রন্থের ভূমিকা অদ্বিতীয়।এটি অনেক বড় একটি গ্রন্থ।কাজেই দীর্ঘ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়।তাই প্রথম তিন-চারটি অংশকেই আলোচনার কেন্দ্রে রাখব। তিনি গ্রন্থের সূচনাতেই লিখছেন যে –

“শত শরদ মানুষের আয়ু। কিন্তু দুঃখী-সুখী-ভ্রষ্টাচারী ততদিন বাঁচে না।মরণের আগে বোকাচোখে তাকিয়ে দেখে ; সমস্তই অসম্পূর্ণ, তার রাকাশশী অসংলগ্ন বালি হয়ে উড়ে যায়।… নিঃশ্বাস নিই তাই বেঁচে থাকি।ভিতরে একা,সুখী না,দুঃখীও না।দশদিকে অসীম শূন্য এবং চিররহস্য।”

    মৃত্যুর মুখে মানুষ অসহায়।জীবন ও মৃত্যুর প্রান্তিক শাসনে বদ্ধ মানুষ আসলে মুক্ত ও বদ্ধ দুইই।মুক্ত এই কারণেই যে সে অনেক কিছু করতে চায় আর বদ্ধ এই কারণেই যে তার ইচ্ছা শক্তিকে নিরঙ্কুশভাবে প্রয়োগ করতে পারে না।এই পৃথিবীর সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যের মধ্যে নিহিত রহস্য এতই বিপুল ও বিস্ময় উদ্রেক করে যে মনে হয় একটি জীবন তার কাছে কিছুই নয়।সুখ ও দুঃখের অনুভূতিগুলো একান্তই ব্যক্তিক ও ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। মৃত্যু মানুষের সামনে এই উপলব্ধি এনে দেয়।

২.
    ‘আমি খুব পৌরাণিক আদরের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হলাম।’ প্রথম অংশ ‘জন্ম’-তে এই লাইনটি পড়ে আমরা চমকে উঠি। এখানে ‘পৌরাণিক’ শব্দটি আমাদের ধাক্কা দেয়।যার মধ্যে মিশে সূক্ষ্ম শ্লাঘা বোধ।এমন আদর যা অনেক পুরাতন – আজকের দিনে শহুরে মানুষদের কাছে অবিশ্বাস্য ও খানিকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলেও মনে হতে পারে।কেমন সেই আদর ? বাঁশ ঝাড় থেকে কেটে আনা কাঁচা বাঁশের চোঁচ দিয়ে নাড়ী কাটা হয়েছিল লেখকের।তিনি লিখেছেন যে – ‘টিটেনাসের বীজ না থাকলেও বনের সবুজ বিষ ছিল।’ কৌতুক মিশে আছে এই কথাটায়। তিনি যে কতখানি আদিম জীবনের সঙ্গে সংসক্ত ছিলেন তা বোঝা যায়।

     লেখক তাঁর মা’কে হারান ভূমিষ্ঠ হবার অব্যবহিত পরেই।তখন তাঁর মা’র বয়স মাত্র উনিশ।সংস্কারবশত স্বজনদের অনেক কটূ গঞ্জনা তাঁকে শুনতে হত। “আবছা কুয়াশাভরা অপরাধ ভিতরে ছায়া ঘনিয়ে আনত।মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা।” (‘মা’)আশৈশব মার উষ্ণ সান্নিধ্য হারা একজন সন্তান যে কতখানি একা ও বিধ্বস্ত হয় তা সেই বোঝে। কিন্তু উল্টোদিকে এই প্রচন্ড চাপা যন্ত্রণা, কষ্ট তাঁকে অনেক স্বাবলম্বী ও মানসিক বলে বলীয়ান করেছে।এই একাকীত্বই প্রস্তুত করেছে তাঁর কবি মনকে।

   “এই নকল দুঃখই বোধ হয় আত্মকরুণা। দুষ্টুমি করে মারধর খেলে আমি ঐ দুঃখকে খুঁজতে বেরুতাম।” শৈশব ও কৈশোরে স্বভাববশত দুষ্টুমি করলে যে মারধর এসে জুটত তাতে কোথাও স্নেহ থাকত না,থাকত রূঢ়তা ও তাচ্ছিল্য।কোন করুণা নয়, বরং মা’কে হারানোর দুঃখকেই সম্বল করে বাঁচতে শিখে গেছিলেন।যে দুঃখ তাঁর একার।অনেক পরিণত মন তাঁর ছোট বয়সেই তৈরি হয়েছিল। তিনি ঘুরে বেড়াতেন নির্জন খালপাড়ে যেখানে কেউ সচরাচর যায় না।একজন বালকের চোখে ভেসে উঠত দিগন্তের মেঘ।যা উত্তরকালে কল্পনা শক্তিকে ইন্ধন জুগিয়েছিল। ‘আমি মুখ নিচু করে দুঃখকে খুঁজতাম, মাটিতে কোথায় সে গেঁথে আছে ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে।'(‘মা’)।মা’র বিয়োগ ব্যথা জনিত বেদনা তাঁর মনে সুগভীর ও স্থায়ী রেখাপাত করেছিল।আগেই উল্লেখ করেছি যে এই বেদনা,কষ্টই তাঁকে অন্যের থেকে অনেক পরিণত ও বলিষ্ঠ করেছিল।তা না হলে কি এমন উপলব্ধি হত – “এতকাল পরে এখন জানি, আসলে সুখও নেই, দুঃখও নেই। সংসার সমাজের এজেন্সিগুলো আমাদের মধ্যে সুখ ও দুঃখের ধারণা জন্মিয়ে দেয়, যে ব্যথা ভোগ করার নয়, সেই ব্যথা ভোগ করায়।” (‘মা’)

    পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব লেখকের মানস পটে যে মা’র ছবি চিত্রিত হচ্ছে সেই মার মধ্যে সেই অর্থে কোন মাতৃত্ব নেই।মাত্র উনিশ বছর বয়সে তাঁর মা পরলোকগতা হন – ‘ছিপছিপে কিশোরী, নাকে পাথর বাঁধানো নোলক।মাতৃত্ব দূরের কথা, তার ঠোঁট চোখে চিবুকে তখনো নারীত্বই আসেনি।এই আমার মা।’ আশৈশব মা’র অমোঘ স্নেহ বঞ্চিত সন্তান তাঁর মৃতা মা’র উদ্দেশে বলছেন – যদি তিনি টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ান তাহলে বলব এসে বসতে।কিছু বিস্কুট,সন্দেশ খেতে।মা’র কাছে মোহময় আব্দার মা যেন কাঁচা পাকা চুলের টেরি কেটে দেয়।মা’র কাছে আসলে সন্তানের বয়স বাড়ে না।’তুমি গতজন্মে আমার মা ছিলে।’ (‘মা’)

৩.
    “মানুষী স্মৃতিই মানুষ।স্মৃতিই জটিলতা।মরণের পরে আমাদের যে নির্বাণ হয় না সে কেবল স্মৃতি আছে বলেই না ! পুনর্জন্ম বড় ম্যাজিক।” (‘প্রথম স্মৃতি’)

      রবীন্দ্রনাথ তাঁর “মানুষের ধর্ম” প্রবন্ধের পরিশিষ্ট ‘মানব সত্য’-তে লিখেছিলেন মানুষের ত্রিজত্বের কথা। মানুষের প্রথম জন্ম হয় ভূলোকে, দ্বিতীয় জন্ম আত্মিক লোকে এবং শেষ জন্ম হয় সর্বমানবের চিত্তদেশে।এই আত্মীক লোকই হল নির্জ্ঞান স্তর।এখানেই মিশে থাকে মিথ, পুরাণ, কিংবদন্তি সহ অজস্র পরম্পরা।যা মানুষের জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য।যেকোন স্রষ্টার মধ্যেই পুনর্জন্মের প্রতি আকর্ষণ ও কৌতূহল থাকে।কবি বিশ্বাস করেন যে সে বিচ্ছিন্ন কেউ নয় সে অতীত থেকে আসা বিরাট প্রবাহেরই অংশ।স্মৃতি আছে বলেই প্রত্যাবর্তন করতে হয়।তাই পুনর্জন্ম ম্যাজিকের মত মনে হয়।

      লেখকের জন্মের পর প্রথম স্মৃতি ছিল এরূপ – দুপুর অনেকটা গড়িয়েছে।তখনও বিকেল হয়নি।মেঝেতে পিঁড়ি পেতে রান্নাঘরের পাশের ঘরটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে।কাঁথা বালিশে মোড়া তার দেহ।মাটির সোঁদা গন্ধ,কাঁথা বালিসের স্যাঁতা গন্ধ,বৃষ্টির ভেজা গন্ধ তাঁর অনুভববেদ্য হয়ে উঠছিল। তিনি দেখছেন যে – শাড়ি পরিহিত কয়েক জোড়া বিশাল বিশাল পা বিছানার পাশ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ এসে থামছে না একবারও।এক জোড়া পায়ে নীল পাড় সাদা শাড়ি।হাঁটু পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন কবি।বলা বাহুল্য যে – তখনও তিনি হামা দিয়ে,কথা বলতে পারেন না। তিনি প্রত্যেকবার ভাবছেন কেউ এসে কোলে তুলে নেবে। কিন্তু আশাভঙ্গ হয়। তিনি লিখেছেন – “হঠাৎ আমার মধ্যে ক্রোধের জন্ম টের পেলাম – রক্তমাংসের পুঁটলিটার মধ্যে বাজপাখি তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠল।ক্রোধ আমার সমস্ত শরীরকে ছেয়ে ফেলছে।আমি কি করে রাগ দেখাব ? ব্যস্, এইখানে এসে স্মৃতি ছিঁড়ে গেছে।…”।(‘প্রথম স্মৃতি’) কেউ তুলে নিয়েছিল কিনা তা তাঁর স্মরণে নেই।তবু ‘ঘটনাটা সামান্য, কিন্তু ইঙ্গিতময়।’ আসলে এই পরিত্যক্ত হয়ে থাকা,সকলের মধ্যে থেকেও একা ও অনাদরে বেড়ে ওঠা, অসহায় ক্রোধ লেখকের জীবনটাকে অন্য রকমভাবে নির্মাণ করেছে।লেখক এই পরিত্যক্ত থাকার কষ্ট ও অসহায় ক্রোধের যোগফলকেই স্বীয় জীবনের সারসংকলন বলেছেন।

     লেখকের ঠাকুমা ছিলেন কৃষ্ণবর্ণা,কুরূপা কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী এক প্রৌঢ়া।একদম মধ্যবিত্ত সনাতন হিন্দু বাঙালি বধূর মত জীবনাচরণ ,হাতে শাঁখা, নোয়া,কালো চুল।কষ্টিপাথরে কোথাও সোনার দাগ নেই।ঠাকুমার গাত্রবর্ণকে এইভাবে উপমিত করেছেন। তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পানের আসর বসাতেন।লেখকের অভিমানভরা তির্যক মন্তব্য – ‘তাঁর কত যুগ আগেকার শুকিয়ে যাওয়া স্তন মুখে পুরে টেনে টেনে মিথ্যেদুধ খেতাম।’ তাঁর ঠাকুমার কোন শ্রেণিচেতনা ছিল না। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন একদম নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের সঙ্গে যাঁদের মধ্যে আছে কামারবাড়ি, গোয়ালবাড়ির বর্ষীয়সীরা,উন্দি নাম্নী যুবতীর মা,রাধু ঘোষালের বউ,শশী কর্মকারের দিদি,সূর্য কর্মকারের মা,মাণিক্যবুড়ি – যাঁরা ‘দুঃখের এবং বয়সের আলাদা এক এক রূপ।’

     লেখকের শিল্পীমনে এঁদের এইভাবে অঙ্কন করেছেন – ”কারো কাঁচা পাকা চুলের গোছায় ঘেরা ধূসর অস্পষ্ট মুখখানা যেন কঠিন বট-অশ্বত্থের ঝুরি নামা মন্দিরের কবাটভাঙা দুয়ারের অন্ধকার, কারো মুখে অজস্র কাটাকুটি রেখা যেন বিকেলের নদীর চরে পাখিপক্ষীর সারা দিনের পায়ের দাগ…কারুর ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত যেন – মানবী না,প্রত্নযুগের বৃহৎদংষ্ট্রা বাঘিনী, এখন বিরক্ত,মন্থর।” মাণিক্যবুড়ি যেন ‘প্রাচীন মাতৃকাগোষ্ঠী’-র একজন।কামার রমণীদের দেহে ধাতুর ধার এবং কলঙ্ক, গোয়ালিনীদের শরীরে ক্ষীরের গভীর লাবণি।(‘ঠাকুমা ও তাঁর বন্ধুরা’)

৪.
    মা প্রয়াত হবার পর লেখকের দিদিমা তাঁকে দেখতে চেয়েছিল তাই ঠাকুমার সঙ্গে কলকাতায় আসেন।প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে মিরজাপুর বা অখিল মিস্ত্রি লেনের সেই বাড়ির দৃশ্যকল্প তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে – শান বাঁধানো উঠোনে জলে টইটুম্বুর চৌবাচ্চা, যার তলাটা নিস্পন্দ সবুজ,রহস্যময়।এক বিস্মিত বালকের চোখে এমন আশ্চর্য স্থানটিকে মনে হয় ‘আমি নামলে তলিয়ে যেতে পারি।’ যে বাড়িতে তাঁর মামার বাড়ি সেই বাড়িওয়ালা সোনার বেনে।সে রাতে মদ্যপ অবস্থায় চিৎকার চেঁচামেচি করত। কিন্তু তাঁর বোন নীহার ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।সে পড়াশোনা করত।গল্প করতে আসত। তাঁর রূপের ‘চুম্বক রহস্য’-র প্রতি গভীরভাবে আসক্ত হন লেখক।একদম বাল্য বয়সে এটাই বোধহয় প্রথম অনুরাগ ও প্রেম ; বয়স সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি – ”সে আমাকে বুকে চেপে ধরে চুমু খেলে ভিতরের পাখি চটপট করে উঠত।” (‘কলকাতা’)

     লেখকের তরুণী ছোটমাসি ভিতরের বারান্দায় তক্তপোশে পড়াশোনা করতেন।সে  ছিল চমৎকার মেয়ে কিন্তু স্বল্পায়ু।পরে টাইফয়েডে মারা যান।লক্ষণীয় যে তাঁর মা ও মাসি দু’জনেই অকালে প্রয়াত হন।এটাই বোধহয় তাঁর জীবনের দ্বিতীয় মৃত্যুশোক।মারা যাবার পর তাঁর বাতিল আস্তানায় স্টিল ট্রাঙ্কের মধ্যে লম্বাচুলের গোছা ও গানের খাতা আবিষ্কার করেন লেখক।মৃত্যু নিয়ে কী আশ্চর্য কাব্যঘন বর্ণনা – “ছোটমাসি দৌড়ে চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে – তার দীর্ঘ দীর্ঘ চুলের প্রান্ত এখনও উড়ছে ইহলোকে।ইহজগৎও স্থির পরজগৎ ও স্থির, মাঝখানে শুধু আমিই কাঁপি।” ছোটবেলা থেকে অনুভববেদ্য ও সংবেদনশীল মনের অধিকারী ছিলেন বলেই এমন বর্ণনা সম্ভব।

     লেখকের মনে পড়ে সন্ধ্যারাত্রে হগসাহেবের বাজারে আলোর বাহার।সেই প্রথম তাঁর মানুষ প্রমাণ আলোর পুতুল দেখা। কলকাতার রাস্তায় ছাদহীন বাসে বসে আকাশ দেখেছিলেন।সীটে সুবেশ মানুষ, রাস্তায় আলোর সারি। তিনি লিখেছেন – ‘শহরে যে-সুখ বাস করে এতক্ষণ ঠিক তার গন্ধটি পেলাম।’ গভীর রাতেও কুলপি বিক্রি হলে তা কিনতেন। মনস্তত্ত্বের বই পড়ার আগেই হাতে কলমে তিনি শিখেছিলেন ঠান্ডার স্পর্শানুভূতি।আসলে প্রত্যন্ত গ্রামে বড় হওয়া লেখকের কাছে এই অনুভূতি একটু অন্যরকম।তবে এই কথাটি গভীর ব্যঞ্জানাঋদ্ধ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যখন ক্ষীণ হয়ে আসে তখনই তৈরি হয় একরকমের শৈত্য।সেই ঠান্ডার অনুভূতিকেই তিনি এইভাবে ব্যক্ত করলেন। অলংকার শাস্ত্রে একেই বোধহয় বলে ‘অপ্রস্ততপ্রশংসা’।

দিদিমা ও ঠাকুমা উভয়ের সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যাবার স্মৃতি মনে পড়ছে তাঁর।

৫.
   একজন প্রকৃতি লগ্ন মানুষ তদুপরি তিনি যদি শিল্পী মনের অধিকারী হন তখন তাঁর সামনে খুলে বিচিত্র অনুভূতির সব জগত। আশ্চর্য সব রূপ রস গন্ধের সন্ধান তিনি পান।সেই ছবি আমরা পাই বারবার তাঁর কবিতাতেও –

  “…বনের সবুজ ভোরে লাল জুতো পায়ে আমরা শিশু / মেলার খেলনার মতো রঙিন আনন্দঠাসা দেহ , / মালবেরিঝোপের চৌদিক ঘিরে নাচতে নাচতে / কখন যে পরিশ্রান্ত বসেছি — কখন বেলা শেষ / চড়ুইভাতির ভাত খুঁটে খেয়ে কখন যে চড়ুই পালাল , / শুধু উনুনের পোড়া কাঠ — অঙ্গারের কালো — / সংসারখেলার সাক্ষী। নির্বাপিত স্তব্ধতা ঘনাল।…” ( ‘দিনশেষ — চিরস্তব্ধ দেশ’ / মৌপোকাদের গ্রাম)।।

 

কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9635459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।

Exit mobile version