পোর্টজিন

নবীন – বর্ণালী সাহা

Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।

barnali saha bengal live portzine

 

“ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো / তোমাতে আমরা লভিয়া জনম ধন্য হয়েছি ধন্য গো ”
-কি রে নবীন, কোথায় চললি?
নবীন গান থামিয়ে ফিরে তাকালো, প্রশান্ত রক্ষিত তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
– এইতো একটা জলসা আছে গানের সেখানেই।
নবীন সেন, ২৫ বছর বয়সের জীবনে দুবার যথাক্রমে ভূগোল ও সংস্কৃতে স্নাতক ডিগ্রি লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন এবং শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন, শিক্ষক পিতা এবং ডাক্তার বড়োদাদার কাছে একটি Hopeless বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। মাতা তাকে বিবাহ দিয়ে সংসারী করতে চাইছিলেন। তার জন্য চলছিলো মেয়ে দেখা, কিন্তু সমস্যা ওখানেও বাধলো। তার বাল্য বন্ধু প্রবীরের সাথে একদিন রাত্রিযাপন করে নবীন বুঝেছে এ জীবনে কোনো নারী সঙ্গ তাকে সুখী করতে পারবে না! একথা বাড়িতে জানানো ইস্তক তার সে বাড়িতে বাস উঠেছে। এখন সে গান গেয়ে যা আয় করে তাই দিয়ে এই প্রশান্ত রক্ষিতের মেসে ভাড়া থাকে আর দুবেলার অন্নসংস্থান করে! সে ভাড়াও চার মাস যাবৎ দিতে পারেনি।
– তা বেশ বেশ, তাহলে এবার ভাড়া টা পাবো আশা করি!
নবীন লজ্জায় চুপ করে থাকে
– দেখো বাপু অনেক সময় দিয়েছি, আমার দিকটাও তো তোমায় বুঝতে হবে নাকি? আমি পরের সপ্তাহে আসবো।
রক্ষিতের যাবার পর নবীন আবার চলতে থাকে জলসার দিকে। এত কিছুর পরেও তার জীবনে কারো প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই, সে শুধু প্রবীরের অপেক্ষা করে। প্রবীর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতা গিয়েছে। যাবার আগে একে অপরকে জরিয়ে ধরে কথা দিয়েছে তারা এক হবেই, সমস্ত সমাজকে উপেক্ষা করে হলেও!
কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। নবীন হঠাৎ দেখে আকাশের বুকে রংধনু। নবীন তাকিয়ে থাকে অপলকে। সে আপনা থেকে গেয়ে ওঠে ” সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনেরো কলরব/ কেবলি আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে, হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব…..”

“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার, নামাতে পারি যদি মনোভার / শ্রাবণ বরিষণে একদা গৃহকোণে দুকথা বলি যদি কাছে তার…. ”
– কী মিস্টার প্রবীর রায়, কার চিন্তায় মগ্ন হয়ে এই গান?
জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে, মৃদু হেসে অপর্নার দিকে তাকালো প্রবীর।
– আপনি ছাড়া আর কার জন্য গাইবো বলুন?
– থাক থাক আর ভণিতা করে কাজ নেই। এ গান কার জন্য তা আর বলে দিতে হবে না। আর কী সামনের মাসেই তো পরীক্ষা শেষ, তারপর বাড়ি আর সে।
প্রবীর হেসে আবার জানালার দিকে তাকায়, অপর্ণা তার পাশে এসে দাঁড়ায়,
– অপা, এই পাঁচ বছরের কলেজ জীবনে তুই আমার একমাত্র বন্ধু, আর আমার সমস্ত বিষয় জানিস, আমার সাথে কথা বলার জন্য তোকেও তো কম কথা শুনতে হয় না! তার পরেও!
– And I think every person is a creation of God, we are no one to judge someone by their, Color, Religion or Sexuality. you are my friend, friendship have no limit Prabir!
প্রবীরের হাতের ওপর হাত রেখে কথাগুলো বলে অপা,
– And I am lucky to have u as my friend Apa.
– এই খুশিতে একটা সিগারেট?
দুজনে হেসে ওঠে, বাইরের বৃষ্টির সাথে মিশে যায় দুই বন্ধুর আনন্দধ্বনি।
_________

রাত ৮ টা, সাল ১৯৯৫। প্রশান্ত রক্ষিতের মেসের ছোটো ঘরটায় বসে প্রবীরের শেষ লেখা চিঠির উত্তর লিখছিলো নবীন।
প্রবীরের পড়া শেষ, সামনের মাসেই সে ফিরে আসছে। চিঠিটা লিখে উঠে এসে শুয়ে পড়ে নবীন। শরীরটা বিশেষ ভালো নেই তার, দুপুর থেকেই হালকা জ্বর। এদিকে ঘরভাড়ার টাকা জোগাড় করতে পর পর অনেকগুলি জলসায় গাইতে হয়েছে তাকে।
– নবীন, ঘরে আছো?
দরজার বাইরে রক্ষিতের গলা।
– হ্যাঁ, আসুন, দরজা খোলা আছে। রক্ষিত ঘরে এসে দেখে নবীন খুব ক্লান্ত ভাবে বিছানা ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করছে।
– কী হে! অসুস্থ নাকি?
– না না, এই অল্প জ্বর আর কী।
রক্ষিত নবীনের কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলে –
– এ কী ! এতো গা পুড়ে যাচ্ছে! আরে আরে উঠছো কেন ? শোও শোও!
রক্ষিত বাইরের কল থেকে জল এনে, রুমাল দিয়ে নবীনের মাথার কাছে বসে তাকে জলপট্টি দিয়ে দেয়, জ্বর কিছুটা কমে এলে নবীন উঠে বসে।
-কিছু তো খাওয়া হয়নি মনে হয়? যাক আমি বাড়ি ফিরে নকুর কে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিও, আমি আসছি।
– কিন্তু আপনার বাড়িভাড়াটা….
কথা শেষ করার আগেই রক্ষিত বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে, এই কড়া মেজাজের প্রশান্ত রক্ষিত হঠাৎ নবীনের কাছে কেন পিতৃসুলভ ব্যাবহার দেখালো !
হুঁমমম —-
মেসের থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন প্রশান্ত রক্ষিত। রাত তখন দশটা হবে, কৃষ্ণপক্ষের এমনি এক রাতে তার একমাত্র ছেলের মুখাগ্নি করে ফিরেছিলেন রক্ষিত। জ্বরাক্রান্ত নবীনের মনে কি সেই ১৫ বছর আগের শেষ দেখা মুখের প্রতিচ্ছবি ছিলো? অন্ধকারে অশ্রুকণা অদৃশ্য রহিলো।

“আশ্বিনের মাঝামাঝি, উঠিলো বাজনা বাজি / পূজোর সময় এলো কাছে”…
আজ মহালয়া, পূজোর সাতদিন বাকি। বারোয়ারিতলায় চক্ষুদান হল মায়ের। নবীন দাঁড়িয়ে দেখছিলো শিল্পীর তুলির টান। বাড়িতে ছোটবেলা থেকে প্রবীর আর সে একসাথে এই চক্ষুদান দেখে এসেছে। বিগত ৫ বছর তা আর হয়ে উঠেনি। মন্ডপ থেকে বেরিয়ে বটতলার কাছের পুকুরপাড়ে গেল নবীন। কত শতাব্দী প্রচীন এই ঘাট জানে দুই বালকের বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের কত সুখ, দুঃখ, মান, অভিমানের কথা –
-“তার মাঝে হল ছাড়া ছাড়ি, গেলেম কে কোথায়”
-“আবার দেখা যদি হলো সখা, প্রাণের মাঝে আয়”
নবীনের সমস্তমনে দোলা দিয়ে গেল যেন এই কণ্ঠস্বর। চকিত চাহনিতে সে দেখলো বটগাছটার গুঁড়ির কাছে হেলান দিয়ে সেই স্মিত হাসি মুখের তার বাল্যসহচর –
– প্রবীর!
– নবীন!
তারপর পুকুরের জলের মাছের সৃষ্ট বুদবুদ জলতল থেকে উঠে মিলিয়ে গেল, ঝরে পড়লো কিছু ভোরের না ঝরা শিউলিরা, যুগলের আলিঙ্গন আর চুম্বনে মিশে গেলো শিশিরের শেষ অস্তিত্ব। অনতিদূরে ঝোপের আড়ালে ছিলো কিছু হিংস্র চোখ, কিছু শালকাঠের লাঠি ও কিছু ধারালো অস্ত্র, আর ছিলো পচে যাওয়া মানসিকতা।

পুকুরে স্নানে অভ্যস্ত প্রশান্ত রক্ষিত আবিষ্কার করে, পুকুরপাড়ে দুই যুবকের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহ। থানায় কেস হয়। বছরখানেক পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর গঙ্গা বক্ষে বয়ে যায় অনেক জল, আবিষ্কার হয় সোশ্যাল মিডিয়া, ফোর জি। ২০১৮ এ অপসারণ হয় ৩৭৭ ধারা। সমকামিতা অপরাধ নয় আর আইনের কাছেও। হ্যাশ ট্যাগের বন্যা হয়। ২০২০ তে নীল আর প্রিয়ম হাত ধরে রাস্তা পাড় হচ্ছিলো। পিছন থেকে আওয়াজ হয় “ওই দেখ ছক্কা”।

 

কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9636459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।

Related News

Back to top button