Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।
১. বিচ্ছেদ, বেদনা, হতাশা , রাজনৈতিক ক্লেদ , নৈরাশ্যকে পাশ কাটিয়ে এক শাশ্বত সমুন্নত জীবনবোধকে কবিতার ধৃতিকেন্দ্রে রেখেছিলেন অলোকরঞ্জন।এই সমুন্নত জীবনবোধটিই আধ্যাত্মিক জীবন দর্শনেরই অন্য রূপ।যার মধ্যে শান্তি ও পরমতাও আছে তেমনই অন্যদিকে যৌবনোচিত সজীবতা ও উচ্ছ্বলতাও বিদ্যমান।রয়েছে মাটির পৃথিবীর প্রতি সংরক্ত টান।সব মিলিয়ে এক মানবমুখী জীবনবোধ।এমনই একটি কবিতা —
” সাঁওতাল পরগণার গ্রাম মন্ত্রমুগ্ধ , রাত্রির সংকেতে / ভয় নেই, ঠাকুমার হাত কাঁপে হাতে কাঁপে / কুপী , / বাড়ির বারান্দা কাঁপে সে আলোয় , / বাঁশবনের গায়ে / জড়ো সড়ো পাতা কাঁপে , কাঁপে বনভূমি , / তাকে ফেলে / কুপীর করুণ আলো অগ্রসর , হয়তো বা / ভূমা / যে এখনো দূরগম্য তাকে খুঁজে নেবে। / নিরুপায় / প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যেন বড়ো একা আমার / ঠাকুমা।”
একরকম সংবেদনায় ভরপুর এই কবিতা।এই সংবেদনার মধ্যেই থাকে গভীর আস্তিক্যবোধ ও তৃপ্তি –
” পঙ্কশয়ন ছেড়ে আজো যারা ওঠে / তারপর চেতনার গভীর প্রহরে / ব্যথার জোয়ারে লেগে ফুল হয়ে ফোটে / কি হবে তাদের জানো ? ফিরে যাবে ঘরে — … / এই বলে চারিদিকে অপার মমতা / বিলিয়ে ছায়ার মতো মুছে গিয়ে বাঁচে, / চাঁদের আলোয় তার মহা নীরবতা, / তবুও ভাবিনা কিছু , আছে , সব আছে।।”
‘আছে সব আছে’ এই কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ বাণী -হে পূর্ণ তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে।কিংবা অমিয় চক্রবর্তী’র মেলাবেন তিনি মেলাবেন।চরম অস্থিরতা ও ভাঙচুরের মধ্যে দাঁড়িয়েও এমন অনপনেয় বিশ্বাস স্থিতধী কবির পক্ষেই সম্ভব। তিনি নিজে এক সাক্ষাৎকারে অকপটে বলেছিলেন যে –
” … অত্যন্ত অনুদাত্ত সম্ভ্রম নিয়ে আমি বলতে পারি , আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী।আমার ভারী মজা লাগে এই ব্যাপারটা নিয়ে দস্তুর মতো অনীশ্বর কোনও শুভার্থী যখন নিক্তি ধরে মাপতে বসেন , এই মুহূর্তে ঈশ্বর আমার কবিতায় কী পরিমাণ বিদ্যমান।”
২. ”কৃত্তিবাস” পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় তাঁর ‘গোধূলির শান্তিনিকেতন’ নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয় –
” আরো কিছুদূরে পিছু ফিরে চায় গোয়াল পাড়ার পর / আঁচলের ধূলি সরিয়ে আমাকে বলে : / মনে আছে তোর স্নান সেরে নিতে রাঙা সায়রের জলে / সকালে আমায় পাড় হয়ে গেছে আমার রাজার রথ ?/ যেই চলে গেছে , চকিতে থেমেছে পাখির প্রভাত ফেরি, / কথা দিয়েছিল : ‘আবার আসব’ , কেন তার এত দেরি ? ”
‘আবার আসব’ এই আশা ব্যঞ্জক শব্দবন্ধের মধ্যেই রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।’যেতে নাহি দিব’ কবিতা মনে পড়ে যায় –
” যতবার পরাজয় / ততবার কহে , ‘আমি ভালোবাসি যাবে / সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ? / আমার আকাঙ্ক্ষা-সম এমন আকুল , / এমন সকল-বাড়া , এমন অকূল , / এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর !’ ”
এই মর্ত্য পৃথিবীতে দুঃখ,বেদনা,বিচ্ছেদ সব আছে কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই মানুষ আছে।মানুষের অনুভূতির জগত আছে।আর রয়েছে অফুরন্ত বৈচিত্র্য রূপ-রস-গন্ধময় প্রকৃতি ; যা সদা আনন্দময়।তাই এখানেই বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।এই আনন্দময় পৃথিবীরই ক্ষুদ্র সংস্করণ আমৃত্যু প্রিয় শান্তিনিকেতন।
“কৃত্তিবাস” পত্রিকার অষ্টম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আগ্রা’ কবিতায় লিখছেন –
” তুমি এই মুহূর্তের মুকুটচূড়ায় ধ্রুবজ্যোতি / নিয়ে এসো তার কাছে যে তোমার একার শাশ্বতী, / যাকে তুমি হৃদয়ের দারিদ্র্যের বৈদূর্যবেদীতে / প্রতিষ্ঠা করেছো , এই মুহূর্তকে তুমি তার পায়ে / নিয়ে চলো , সেও আজ অশ্রুহারা , দিনের নিভৃতে / এ নদীর মত সেও নিজের ভিতরে মরে ত্রাসে / গভীর স্মৃতির টানে নিজেরে সে রুগ্ন ক’রে যায় / তাকে এই গোধূলিতে নিয়ে যাও যুক্তির আকাশে।”
ইতিহাস চেতনার সঙ্গে অনুস্যূত মিথ ও পুরাণে সমাকীর্ণ এই কবিতা।ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহার মনে করিয়ে দেয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’কে।
‘ওখানে’ কবিতায় পাচ্ছি –
“একটা পাখি টোল খেয়ে / আকাশ পার হ’লো / পড়লো আলো টাল খেয়ে , / অন্ধকার হ’লো। / ওখানে কিছু কাঁপানো ওরে / তোমার নিশ্বাসে, / ঈশ্বরের দুহাত ধরে / সময় যায় , আসে।।”
মেদুর ও মায়াময় এই কবিতায় স্পষ্টতই উচ্চারিত ঈশ্বর চেতনা।
৩. ‘আমার মাতামহের নির্দেশ’ শীর্ষক কবিতায় প্রাচীন সংস্কারের প্রতি টান , মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা পরিস্ফুট হয়েছে –
” বাড়ি করবে যখন , তখন / বাড়ির পশ্চিম দিকে বাঁশবন রেখো , / জমাট পাহারা দেবে বাঁশবন , অনিদ্রা প্রবণ।”
বাড়ির দক্ষিণে মহানিম গাছ , উত্তরে ঘরের কোণে কৃষ্ণচূড়া আর পূর্ব দিকে দিঘি।এই কবিতার অনুষঙ্গে ফুটে ওঠে প্রাচীন বাংলাদেশের গ্রামের প্রত্নস্মৃতি।যৌথ জীবনের ঘনত্ব মনে করিয়ে দেয়।
অনাবিল নিরাভরণ সহজিয়া সুর ভেসে ওঠে ‘যে রাখাল দূরদেশী’ কবিতায় —
” গোধূলি ঘনায় , মিলনে বিরহ জাগে, / সেই তো ধরণী শোণিতে আবহমান ;/ কে তবু বলল ট্রামে উঠবার আগে ;/ ‘এবার কিন্তু আঙ্গিক বদলান।’ / তবে শোনো , এই নগরীর সন্তান / আমিও , অথচ যে রাখাল দূরদেশী, / আমি তার কাছে সঁপেছি মনপ্রাণ, / কেননা শহরে পাঠভেদ বড়ো বেশি।”
এই কবিতায় শহুরে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত সমালোচকদের উদ্দেশে এক প্রকার তির্যক বক্রোক্তি আছে।অন্যদিকে এই পরিশীলিত গীতলতা ও সহজিয়া ভাবনার মধ্যেই রয়েছে অধ্যাত্ম জীবন দর্শনের বীজ।
দক্ষ যজ্ঞ ও সতীর দেহত্যাগের বিখ্যাত পৌরাণিক কাহিনীটিকে অবলম্বন করে একটি অসামান্য কবিতা তিনি লিখেছিলেন –
” বিভিন্ন শহরে মহাদেশে / কলকাতার সতীদেহ ছিন্ন ছিন্ন ছড়ানো রয়েছে ? / দক্ষযজ্ঞ শেষে আজ কলকাতা — পার্বতী আমার — / তোমার দেহের দুটি বুক আমি হৃদয়ে রেখেছি।”
গোটা কলকাতা শহরের দ্রুত বদলে যাবার ছবি তাঁর কবি দৃষ্টিতে সতীর ছিন্ন শরীরের মত মনে হয়েছে।যন্ত্র সভ্যতায় আগ্রাসনে আজ গোটা শহর , সবাই সাফল্যের ইঁদুর দৌড়ের শরিক , একরকমের অনিকেত মনোবৃত্তি ও নৈঃসঙ্গ্য বোধ গোটা শহরের মানুষকে গ্রাস করেছে।
বিমূর্ত ঈশ্বর’কে নিয়ে তাঁর আশ্চর্য কবি কল্পনা মূর্ত হয়েছে ‘পান্থ’ কবিতায় –
“মাঝে মাঝে স্পষ্ট করে বলা দরকার / ঈশ্বর আছেন , / মগডালে — বসে — থাকা পাপিয়াকে আর / পর্যবসিত বস্তু পৃথিবীকে স্নান করাচ্ছেন।”
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কুশল পাহাড়ী’ গল্পে কবির্মনীষীর কথা বলেছিলেন।ঈশ্বর যেন কবিরই মতন যিনি বিপুল বৈচিত্র্যময় জগত সৃজন করেছেন।অলোকরঞ্জনের কবি কল্পনায় ঈশ্বর যেন বস্তু বিশ্বকে স্নাত করছেন। আশ্চর্য কৌতুক দীপ্ত লাইনটি।
৪. সম্প্রদায় হল বহিরঙ্গের বিষয়।ধর্মের মূল কথাই অন্তর্নিহিত শুভত্ব ও শুদ্ধসত্ত্ব বোধের সম্যক জাগরণ।যা মৌলবাদী চিন্তা থেকে প্রকৃত চেতনা সম্পন্ন ধার্মিককে পৃথক করে।এমনই দু’টি কবিতা —
” বুদ্ধমন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল / এক বেশ্যা ঢুকে যায় পেছন – দুয়ার ঠেলে / দাঁড়িয় বুদ্ধের ঠিক পাশে ; / দুটি দেবদারু দেয় দ্বার প্রান্তে সযত্নে পাহারা / কেউ যেন বুঝতে না পায়, / শ্রমণ বুঝতে পারলে যাচ্ছেতাই হবে, / এই জেনে চত্বরের মাঝখানে ভূস্পর্শ মুদ্রায় / জাপানি গাছের চারা শান্ত পরিবেশ এঁকে তলে, / গাছ,ফুল,শ্রমণের ঘন ঘুম থাকে / ভীষণ সাহায্য করে সে-নিষিদ্ধ নারী / বুদ্ধকে কী বলেছিল প্রচলিত ভিক্ষুর বিষয়ে।” (‘এক বেশ্যা অনায়াসে ভিতর মন্দিরে ঢুকে যায়’)
কথিত আছে বুদ্ধই সঙ্ঘে নারীর প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন।এই কবিতায় দেখছি একজন পতিতা সামান্যা নারী এসেছেন বুদ্ধ মন্দিরে। কিন্তু মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি চুপিচুপি পিছনের দরজা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন।সকলের মত সেও শরণাগত হতে চায় , বাহ্যিক জীবনের কালিমা মুছে হতে চায় আর সকলের মত হয়তো নিজের জীবনকে চিরতরে বুদ্ধের কাছেই উৎসর্গ করতে চায় – বেছে নিতে চান স্বেচ্ছায় শুদ্ধ সাত্ত্বিক জীবনকে। কিন্তু রয়েছে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা , প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসন।তাই সে নীরবে নিভৃতেই জীবনের একমাত্র আলম্বনকে স্মরণ করেন।বুদ্ধকে সে প্রচলিত ভিক্ষুর বিষয়ে কী বলেছিল তা অগোচরেই থেকে যায়।
” লুপ্ত হয়ে যায় শরীর , আমি আজ বিশ্বকল্যাণে / তোমার চুম্বন করেছি প্রার্থনা।মশাল জ্বেলে কারা / এখুনি ছুটে গেলে , “মৌলবাদী ওরা” বলেই একজন / সে-দলে ভিড়ে গিয়ে আমার উদ্দেশে দেখাল তর্জনী ;/এত সহজ আজ দৃষ্টিকোণগুলি নিপুণ অনায়াসে / বদল করে নেওয়া দলে না গিয়ে তবু তোমার চুম্বন / দাবি করেছি বলে ছোরা বলে শানিয়ে ওরা আমায় ঘিরে আসে।” (‘মৌলবাদী নই’)
ভালোবাসার কাছে হয়তো সমস্ত সম্প্রদায়,ভেদাভেদ,ধর্মীয় অচলায়তন সব তুচ্ছ হয়ে যায়।শরীর লুপ্ত হয়ে যায় জেগে ওঠে অন্তর্নিহিত শুভত্ব ‘বিশ্বকল্যাণ’।কবি শুধু কামনা করেন প্রেয়সীর চুম্বন।আর তখন চারিদিক থেকে ধেয়ে আসে বিষাক্ত সব আক্রমণ।জ্বলে ওঠে মৌলবাদের রক্তচক্ষু। কিন্তু যিনি কবি , ভালোবাসা যাঁর মর্মে , তিনি কখন মৌলবাদী হতে পারেন না।
যাঁর চিন্তা,ভাবনা ও মননের শিকড় নিহিত আছে এমন সমুন্নত অধ্যাত্মবোধের মধ্যে তিনিই এমন সব অনবদ্য কবিতা সৃজনে সক্ষম।।
কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9635459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।