নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’র ‘সন্ধ্যারাতের কবিতা – সুমন ব্যানার্জি
Bengal Live পোর্টজিনঃ পোর্টজিন কি? পোর্টজিন একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহের রবিবার এটি বেঙ্গল লাইভের (bengallive.in) এর পোর্টজিন বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়।
১. নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,যিনি ‘লিরিকের জেলখানা’ থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করে সর্বসমক্ষে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন;চাবুকের মত গদ্যে কবিতা লিখেছেন,ছন্দকে নতুন করে চিনিয়েছেন।তাঁর ‘সন্ধ্যারাতের কবিতা’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ এমনই ভাবনাকে বহন করে।উক্ত কাব্য গ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতার কাব্যভাষা ও রূপকল্প নিয়ে আলোচনাই প্রবন্ধের মূল অন্বিষ্ট।
সন্ধ্যারাতের কবিতা এই নামের মধ্যে দিয়েই কবিতার অন্তঃস্থ ধ্বনি/ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে।গোধূলির অবসানে সন্ধ্যা ও রাতের প্রকৃতির মতনই স্তব্ধ,নির্জন,মায়াময় ও নম্র উচ্চারণ তাঁর কবিতার মধ্যে।কিন্তু,প্রকৃতি একজন রোমান্টিক কবি মানসে যেভাবে ধরা দেয়,রোমান্সরাগ জড়িত আবেগের বিস্ফার ঘটায়,একটা অতি-প্রাকৃত স্পন্দন সৃষ্টি করে ,উক্ত কাব্যে তা খুব তীব্র ভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না।বলা বাহুল্য যে,তাঁর কাব্যভাষার মধ্যে এত মরমী,আবেগ কল্পনার বিস্তার দেখা যায় না।অত্যন্ত সহজ ও অনাড়ম্বরভাবেই তিনি নির্মাণ কররন তাঁর স্বীয় রূপকল্প:তাঁর কাব্যভাষা গদ্যের মত ঋজু ও সজীব।
কবি সুবোধ সরকার তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন ‘দেশ’ পত্রিকায় যে,
“…তিনি আত্মকৌতুক করে বলতেন,’আমার অত কল্পনা নেই,কল্পনা লতা নেই,আমি যা দেখি তার থেকে তুলে নিই,তার থেকে বেশি উপাদান আমার দরকার নেই।’তিনি বিশ্বাস করতেন দ্বিতীয় বিদ্যায়।কাকে বলে দ্বিতীয় বিদ্যা?তাঁর একটি প্রাতঃস্মরণীয় কবিতায় তিনি লিখেছেন,’বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।…’গসপেলের মত লাগল?গসপেল কবিতা হতে পারেনি,এক ইঞ্চি দূরে এসে থেমে গেছে।ওই থেমে যাওয়ার পর এই কবিতার জন্ম।…”
২. ‘সন্ধ্যারাতের কবিতা’র ৯ নং কবিতা ‘মাঠের শিহরে কালো মেঘখানি’;ঘন ঘাসে ঢাকা কালো মেঘখানিকে ‘সারাদিনমান’ অভিমান বুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন কবি ‘বড় চাপা অভিমান বুকে’।আষাঢ়ে মেঘের আগমন খুব স্বাভাবিক,তবে যখনই অভিমানের কথা বললেন তখনই কাব্যভাষা হয়ে উঠল সূক্ষ্ম ও সুন্দর।কবিতার শেষ স্তবকে আনলেন গ্রামের সরলমনা কালোমেয়ের প্রসঙ্গ-”ও মেঘ,ও কালো মেঘ,তুমি সেই কালো মেয়েটিকে/ফিরিয়ে এনেছ এই আষাঢ়ের বিকেলবেলায়।”প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যকে তিনি একটি মেয়ের প্রতীপে সংস্থাপন করলেন;কাব্যভাষা হয়ে উঠল রূপময়।
১৬নং ‘মেঘলা দিনে’ কবিতায় কবি মেঘকে ব্যবহার করলেন স্নেহছায়ার অনুষঙ্গে-“জানলায় দাঁড়িয়ে সারাটা দিন আমার/মনে হচ্ছিল,/কেউ যেন তার স্নেহছায়ায়/সবকিছুকে ঢেকে রেখেছে।”ছায়ার মধ্যে কবি দেখছেন তাঁর দৈনন্দিন যাপনকে।তিনি অতীতের স্মৃতিকে উপমিত করেছেন ‘পানাপুকুর’র সঙ্গে-“সবকিছুকেই জলে-ধোয়া সেই স্নিগ্ধ কোমল/ছবির মতো দেখাচ্ছিল,/যা অনেক বছর,অনেক অনেক বছর ধরে/স্মৃতির পানাপুকুরের মধ্যে…”।
২০নং ‘কিছু স্মৃতি,কিছু শালপাতা’ কবিতায় স্মৃতিকে তুলনা করেছেন ‘বাক্সের ভিতর কিছু শুকনো শালপাতা’র সঙ্গে।কবিতায় একদম শেষে যে বটগাছের কথা লিখেছেন তা হল তা আসলে প্রাচীনতার প্রতীক, জীবনেরই রূপকল্প।যেখানে পুরোনো দিনের স্মৃতির অনুরণন তৈরি হয়-”রাস্তার খড়কুটো নিয়ে খেলা করে হওয়া/ক্কচিৎ কখনও/তারই ছোঁয়া লাগে এসে বটগাছের ডালে।
৩. ২৭নং কবিতাতে কাব্যভাষার সূক্ষ্মতা এক অনবদ্য স্তরে উন্নীত হয়েছে-“অন্ধকারে কেউ কাউকে ডেকে ফিরেছিল/উন্মাদের মতো।/সেই ডাক এখনও কানে বাজে।…মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ধারালো করাত চিরেছিল/ধোঁয়াটে আকাশটাকে।…”
বিদ্যুতের ধারালো করাত’,’কালো আকাশের বুক’ ইত্যাদি কথার মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত হয় কবির নস্টালজিক মন;যিনি অতীতচারী-“অন্ধকারে কেউ কাউকে ডেকে ফিরেছিল/উন্মাদের মতো।/সেই ডাক এখনও কানে বাজে।/অথচ কে ডেকেছিল,কাকে ডেকেছিল,আমি কিছুই জানি না।”
আঁধার রাতের বৃষ্টি তাঁর মনে ফিরিয়ে আনছে কলকাতার বুকে জমে থাকা স্মৃতির কোলাজকে।
৩২নং ‘হাওয়ার মুখে’ কবিতায় স্মৃতিরই এক পর্যটন;পাশাপাশি রোমান্টিক উচ্ছ্বলতা এক সংহত প্রকাশ-“রাত্রি যখন ফুরায়,তখন নদীর গভীর থেকে/হঠাৎ জাগে উল্টোপাল্টা হওয়া।/যে চলে যায় নদীর ঘাটে পায়ের চিহ্ন রেখে,/এইভাবে তার কোথায় চলে যাওয়া,…”।লক্ষণীয় যে,এই কবিতাতেও এসেছে ‘বৃদ্ধ বট’র প্রসঙ্গ।হওয়া এসে লেগে বটের মনে স্মৃতিকে জাগরুক করে দেয়-“হওয়াই জানে,পাগলাটে ওই হওয়াই সেটা জানে।/সেই গিয়ে সব খবর শোনায় বৃদ্ধ বটের কানে।”কবিতায় উল্লিখিত ‘হওয়া’,’বট’,”নদীর জল’ শব্দগুলি অতীতের নির্ভেজাল স্মৃতির অনুষঙ্গেই এসেছে-“গোপন কথা ছড়িয়ে পড়ে এইখানে ওইখানে।/নদীর জলেও কাঁপন লাগে স্রোতের চোরা টানে।”
৩৪ নং ‘নদীতে রয়েছে চোরা টান’ কবিতাটি আশ্চর্য সুন্দর একটি সৃষ্টি।নদীর স্রোতের বিভঙ্গের সঙ্গে কবি তুলনা করছেন নারীকে-“দৃশ্যত যে এত শান্ত,তারও তলে-তলে/এই তবে ব্যাপার?/নদী ও নাতরীর মধ্যে কালকে আমি কিছুমাত্র তফাত দেখিনি।/ও কি তবে সেই নারীরই প্রতিচ্ছবি,যার/মুখে হাসি,ভিতরে দুর্জয় অভিমান?”নদী শব্দটি স্ত্রী লিঙ্গবাচক;দীর্ঘ এই কবিতায় নদীকে কেন্দ্র করে যা কিছু হয় তারই মিতায়তনিক বর্ণনা তিনি দিয়েছেন।সংসারের অন্দরমহলও আবর্তিত হয় একজন নারীকে কেন্দ্র করেই।কিন্তু,সমাজ-সংসার ও পরিস্থিতির চাপে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা অব্যক্ত থেকে যায়,অনিঃশেষ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় মুখ বুজে;কোন কোন সময় সেও প্রতিবাদ করে,যেমন নদীতে আসে বান-“কিন্তু আমি জানি/যে-কোনো মুহূর্তে তার ওই চেহারা পালটে যেতে পারে,তার বুকে/অকস্মাৎ ডাকতে পারে বান,/সংসারের মুখে লাথি মেরে/দিগ্বিদিক ছুটতে পারে ওই নদী আবার।/ওই নদী দৃশ্যত শান্ত,কিন্তু আমি জানি ওর বুকের ভিতরে/রয়ে গেছে/আর-এক চেহারা,অন্য আকাঙ্ক্ষা,অজস্র চোরা টান।”
৪. নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’র কাব্যভাষা,রূপকল্প বা চিত্রকল্প সিদ্ধহস্ত এক কবি:যা তিনি সহজ,সরল,জটিলতাহীন মুখের ভাষাতেই অবলীলায় সৃষ্টি করেন।গোটা ‘সন্ধ্যারাতের কবিতা’ বইটির আলম্বন বিভাব হল স্মৃতি আর উদ্দীপন বিভাব প্রকৃতি-এই দু’য়ের মণিকাঞ্চনযোগে কবিতাগুলি হয়ে উঠেছে গোধূলির মত বেদনাঘন ও মায়াবী।।
তথ্যভিত:-
১.’সন্ধ্যারাতের কবিতা’,নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।আনন্দ প্রকাশনী,সংস্করণ-জানু,১৯৯৭খৃ:।
২.’দেশ’ পত্রিকা,২রা জানুয়ারি,২০১৯খ্রি:;সুবোধ সরকার’র প্ৰবন্ধ ‘কলম দিয়ে নয়,চাবুক দিয়ে লিখেছেন কবিতা’।।
কীভাবে লেখা পাঠাবেন?
নীচে উল্লিখিত হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার কিংবা ইমেল আইডিতে লেখা পাঠাতে পারবেন।
হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার~ 9636459953
ইমেল আইডি~ bengalliveportzine@gmail.com
লেখার সঙ্গে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং একটি ছবি পাঠানো আবশ্যক।
ভ্রমণ কাহিনীর সঙ্গে নিজের তোলা দুটো ছবি পাঠাতে হবে।