পোর্টজিন

জটু কাকীমা ও দিলীপ মস্তান

Nblive পোর্টজিনঃ

শিবনাথ পাল

জটু কাকারা আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে আমাদের পাড়া মনসা তলায় ভাড়া এসেছিলেন। মদন পাল এর বাড়িতে । আমরা তখন ছোট। শুনতাম জটু কাকারা বাংলাদেশী। ও দেশ থেকে তাড়া খেয়ে এদিকে পালিয়ে এসেছিল। পুরো নাম জটুরাম চক্রবর্তী। জটু কাকার সংসারে ছিল তার স্ত্রী যার নাম জানিনা, আমরা জটু কাকীমা বলেই ডাকতাম । একটি মেয়ে ছিল রীনা আর একটি ছেলে রিন্টু । মেয়েটি বড় আর ছেলেটি ছোট। কাকীমা কাকুর থেকে প্রায় বছর দশেকের ছোট হবে। আর দেখতেও বেশ সুন্দরী, ফর্সা ,ছোট খাট গোলগাল, নরম সরম কেমন সন্ধ্যা রায় সন্ধ্যা রায় ধরনের।

জটু কাকা নিরবিরোধী লোক। এদেশে এসে একটা পাম্প, নজেল সারানোর দোকান খুলেছিলেন রাস্তার পাশের একটা দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে। সারাদিন কালি ঝুলি মেখে কাজ করতেন। বেশি কথা কিছু বলতেন না। আর কাকিমাও তদ্রুপ। খুব শান্ত আর ঘরোয়া। সারাদিন টুকুর টুকুর করে ঘরকন্না র কাজ করতেন। কাকিমা ভালো বড়ি দিতে পারেন বলে আসে পাশের প্রতিবেশী বাড়ির বউরা তাকে খাতির করতো । এছাড়া কাকিমা ভালো রান্না করতেও পারতেন, বিশেষ করে তার হাতের ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাকের ঘন্ট বা লইট্যা মাছের ঝুরি যে না খেয়েছে সে বুঝতেই পারবেনা যে তরকারির স্বাদ যে এমন অমৃতের মতো হতে পারে।

তারপর অনেক গুলো বছর কেটে গেছে। জটু কাকা এখন প্রায় পঞ্চান্ন, আর কাকিমার ও দু- একটা চুলে রুপোলি পাক ধরেছে। জটু কাকা কাঠা দেড়েক জায়গা কিনে মনসা তলা তেই একটা একতলা বাড়ি করেছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটা ইলেভেন এ পড়ে। কিন্তু জটু কাকার সেই ব্যবসা আর নেই। দোকান ঘর খানা আছে কিন্তু পাম্প নজেল এর ব্যবসা আর চলে না। পলিউসন এর জন্য সরকার পুরানো গাড়ি বাতিল করে দিচ্ছে। ফলে লোকে আর পয়সা খরচ করে সেগুলো রিপেয়ার করে না। অর্থাভাবে নানা দুশ্চিন্তায় কাকু ও ভেঙে পড়লেন। ছয় ফুট দু ইঞ্চির লম্বা চওড়া লোকটা দেখলাম ঝুঁকে পড়েছে। আর ওনার হাঁটু র ও প্রবলেম শুরু হলো। দশ পা একবারে হাঁটতে পারেন না। দোকান টা মাসখানেক বন্ধ হয়ে পড়ে থাকল। তারপর কিছুদিন পরে দেখলাম জটুু কাকা কিছু বিড়ি, সিগারেট, পটেটো চিপস, চকোলেট সাজিয়ে নিয়ে দোকান টা চালু করেছেন।

এই সময় কাকিমার একটা অন্য রূপ দেখলাম। স্বামীকে ধরে ধরে দোকানে নিয়ে আসা ও দোকানে বসে কাকুর সাথে দোকান দারি করা। একজন গৃহ বধূ হঠাৎ রাস্তার পাশের দোকানে বসে পান বিড়ি সিগারেট খৈনি বিক্রি করলে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ তাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারে না। অনেকেই ব্যাঁকা মন্তব্য করতো। আমরা বললে কাকিমা বলতেন, “বাবুরে বাংলা দ্যাশে এর থিইকা অনেক বেশি অপমান সহ্য করসি রে”।
আমার মাকে কাকীমা দিদি ডাকতেন। আমাদের বাড়িতে একদিন কাকীমা এসেছিলেন সত্য নারায়ণের নেমন্তন্ন করতে। মা বলল ” হ্যাগো রিন্টুর মা, দোকানে বসতে তোমার লজ্জা করে না?” কাকিমা বললেন “করতো দিদি কিন্তু প্যাটের দায় বড় দায় আর আপনের ভাইয়ের লাইগ্যা আমি সব কিসু করতে পারি”। সেই করতে পারাটা যে কোন পর্যন্ত যেতে পারে তা বুঝলাম কয়েক মাস পরে। সত্যি মানুষের মধ্যে যে আরো কত মানুষ লুকিয়ে থাকে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে।

এর কয়েকমাস পরে। দুর্গা পূজা আসছে। বিভিন্ন ক্লাবের কর্ম কর্তারা হিন্দু ধর্মের রক্ষার দায়ভার স্ব হস্তে গ্রহণ করেছেন । একাশি ফুট দুর্গা কি হাজার হাতের দুর্গার চমক । প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে লাইটিং বা থীম এর চমক আনার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার পুজো বাজেট তৈরি করছেন। নিরীহ এলাকা বাসীর ও ব্যবসায়ী দের উপর প্রবল প্রতাপ প্রদর্শন পূর্বক চাঁদা আদায় করছেন। কারো বাড়ী পাঁচশ টাকা , কারো দোকানে দু হাজার টাকা বিল লটকে দিচ্ছেন।
যাহোক সেই দিনটির কথা বলি। আমি এই সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে ফিরে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আজ তৃতীয়া। জটু কাকার দোকানে এলাকার বিখ্যাত পুজো “আমরা কজন” এর ছেলেরা ঢুকল চাঁদা আদায় করতে। এই ক্লাব কে লোকে লম্বু দিলীপ ওরফে দিলীপ মস্তান এর এর ক্লাব বলেই চেনে ও ভয় করে। সেই ক্লাবের সেক্রেটারি লম্বু দিলীপ স্বয়ং তার চার জন চেলা নিয়ে হাজির। আমরা বুঝলাম আজ একটা ঝামেলা বাধবে।
লম্বু দিলীপ দোকানে ঢুকেই হুঙ্কার দিলো “এই শুয়ার, চাঁদা ক্লাবে গিয়ে দিয়ে আসিস নি কেন” । জটু কাকা বললেন “আরে আমরা তো ব্যবসায়ী সমিতিতে চাঁদা দিসি , তুমি মুখ সামলাইয়া কথা কও দিলীপ”
এক সাগরেদ বলল ” মাল টাকে ক্লাবে নিয়ে গিয়ে দু চার চাপ্পর দিলেই সুর সুর করে টাকা ছাড়বে”
দিলীপ বলল ” ফালতু কথা ছাড় জটু , আজ দু হাজার টাকা চাঁদা দিবি তারপর তোর কেনা বেচা চলবে”।
লোকজন ও দিলীপ কে দেখে দোকান থেকে চলে যাচ্ছিল।
এরকম মিনিট দশেক চলল, জটু কাকাও মাথা নোয়াবে না আর দিলীপ ও ছাড়বে না। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আমরাও দূর থেকে দেখছি কি হয়। এইসব মস্তান রা এই ভাবেই ভয়ের আবহাওয়া বজায় রাখে যাতে তাদের তোলা আদায়ে বিঘ্ন না ঘটে। এখন এই জটু কাকা প্রতিবাদ করে যদি জিতে যায় তবে দিলীপ সমস্যায় পড়বে। এটা প্রেস্টিজের বেপার।হঠাৎ দিলীপ জটু কাকার গালে একটা সপাটে থাপ্পড় কষাল ,অসুস্থ মানুষ টা “বাপরে” বলে চেয়ারে বসে পড়লো। আমরাও ভাবছি এবার একটা কিছু বলা দরকার। এদিকে দিলীপ এর এক সাগরেদ দেখি মেশিন বার করছে।
এমন সময় কি করে জানিনা জটু কাকীমা কোথা থেকে খবর পেয়ে হাজির। চুল এলোমেলো, শাড়ী অগোছালো, দু চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে, এসে ই কোনো কথা নেই দিলীপ এর মুখে সপাটে এক চড়, দিলীপ যে দিলীপ এতবড় গুন্ডা সেও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এক সাগরেদ খপ করে কাকিমার হাত চেপে ধরলো,” বলল গুরু আজ এই মালটাকেই ক্লাবে নিয়ে চল, ফূর্তি জমে যাবে”।
কাকিমা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে নিমেষে একটা রামদা বের করে দিলীপ এর গলায় ধরলো। চিৎকার করে উঠলো ” দিলপা শুইন্যা যা ইজ্জতের দিকে নজর দিছিলো , তো বাংলা দ্যাশে তোদের মতো দুইটা রাইক্ষস কে এই দাও দিয়াই কাইটা ফায়লাইছি। মায়ের দুধ খাইলে আগা, দেখি তুই কেমন মরদ আছিস”

দিলীপ কে তার পর থেকে আর আমাদের পাড়ায় ঢুকতে দেখি নি আর জটু কাকিমাকেও সেই থেকে আমরা পাড়ার লোকরা একটু অন্য চোখে দেখে।

Related News

Back to top button