কেদারাঃ একলা জীবন ও নীরবতার গান নিয়ে ইন্দ্রদীপের প্রথম ছবি

চিত্রশিল্পী যেমন তাঁর তুলির টানে ভরিয়ে তোলেন সাদা ক্যানভাস, ঠিক তেমনই ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত-র ক্যানভাস ভরিয়ে তুলেছেন কৌশিক গাঙ্গুলি। ছায়াছবিঃ কেদারা। লেখাঃ শ্রীজাত। অভিনয়ঃ কৌশিক গাঙ্গুলি, রুদ্রনীল ঘোষ। পরিচালনাঃ ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। প্রাপ্তিস্থানঃ হইচই

Bengal Live বিনোদন সৌম্যদীপ গুহঃ কেদারা-কে ছায়াছবি না বলে রং তুলিতে আঁকা ছবি বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না। চিত্রশিল্পী যেমন তাঁর তুলির টানে ভরিয়ে তোলেন সাদা ক্যানভাস, ঠিক তেমনই ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত-র ক্যানভাস ভরিয়ে তুলেছেন কৌশিক গাঙ্গুলি। যোগ্য সঙ্গতে রুদ্রনীল ঘোষ। কেদারা-য় আর কোনও চরিত্রের প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। এ ছবি মানুষের রোজনামচা, লড়াই, ইঁদুর দৌড়, পার্থিব বস্তুর পেছনে ছোটাছুটি থেকে যোজন দূরের এক ছবি। এ ছবি বলে না তথাকথিত সমাজের কথা। বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে মিল না রেখে কেদারা হয়ে ওঠে এক পরাবাস্তবের ছবি।

সম্প্রতি আইসোলেশন শব্দটির সাথে আমরা ব্যাপক ভাবে পরিচিত হয়েছি। পরিচিত হয়েছি স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা আইসোলেশনে থেকেই কাটিয়ে দিতে পারেন আস্ত একটা জীবন। সঙ্গী হিসেবে থাকে নিঃসঙ্গতা ও এক সুরেলা নৈঃশব্দের অনুরণন। অদ্ভুত ভাবে এই নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা কষ্টের নয়। বরং অনেক আনন্দের। এই নিঃসঙ্গতা বয়ে বেড়াতে হয় না। এই নিঃসঙ্গতায় বয়ে চলা যায়। যে মানুষগুলো ভিড়ের মাঝে থেকেও প্রতি মুহূর্ত নিঃসঙ্গ কাটান, তাঁদের জীবনের মতো যন্ত্রণা নেই এই জীবনে।

সমাজের চোখে অস্তিত্বহীন এই মানুষগুলো। অথচ সমাজ জানেই না এই মানুষগুলো আর পাঁচটা মানুষের মতো সমান্তরাল অস্তিত্বের দাবী রাখে তার জীবনে। নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব নিজেই নিজের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সব মানুষ একা হতে পারে না। একা থাকতে হলে একাকিত্বকে নিজের জীবনের সাথে জাড়িয়ে নিতে জানতে হয়। নিঃসঙ্গতায় কাটাতে হলে ভাল মন হওয়ার সাথে আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী হতে হয়। যা সবার মধ্যে থাকে না। নিজের মধ্যে নিজেকে গভীর ভাবে খুঁজে পাওয়াই যে একাকিত্ব। উদাস দুপুরে দূরে কোথাও বাঁশির সুর মনকে যেমন একা করে দেয়, সেই রকম একাকিত্বের গল্প বলে কেদারা। নিজের সুরে সুরে গানে গানে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়াই যে জীবন। কেদারা-য় সেই জীবনকে যাপন করেন নরসিংহ ওরফে কৌশিক গাঙ্গুলি।

কেদারা ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত-র প্রথম ও জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি। তিনি নিজে স্বনামধন্য মিউজিক কম্পোজার। তার ভাবনায়, শ্রীজাত-র লেখায় স্বপ্নের জাল বুনে যান অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলি। চরিত্রকে নিঃশব্দ রেখেও কতই না কথা বলানো যায় কেদারা-র মতো করে। কৌশিক গাঙ্গুলির চরিত্র নরসিংহ-র মডিউলিশন হতবাক করে দেওয়ার মতো। বকলমে শিখিয়েও দিয়ে যায় নবাগতদের। পাশাপাশি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দেয় তথাকথিত অভিনেতাদের।

পুরো ছবি জুড়ে কৌশিক গাঙ্গুলি-র থেকে চোখ সরানো যায় না এক পলক। চরিত্রের নির্দিষ্ট ম্যানারিজমকে নিজেই ভেঙেছেন, নিজেই গড়েছেন নতুন ভাবে। বারংবার। এই ভাঙা গড়াকে অদ্ভুত ভাবে সমর্থন করে গেছে সিনেমাটোগ্রাফি। সর্বপরি আলোর ব্যবহার! কেদারা-তে নরসিংহ ও আলো পরস্পরের সাথে সাপ-লুডোর মতো খেলেছে। ইনডোরের প্রত্যেক দৃশ্যকে যেন শাসন করেছে আলো। রহস্যের মায়াজাল বুনেছে নরসিংহ-র বাঙ্ময় দুটি চোখ। পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির পাশাপাশি অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলির অভিনয়ের কিছু ইম্প্রোভাইজেশন চমকে দেবার মতো। বন্ধ ও বদ্ধ ঘরে নানান চরিত্র হয়ে নিজের সাথে কথা বলা শিহরণ জাগায় শরীর জুড়ে।

কথায় আছে Morning shows the day, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত-র প্রথম ছবি মনকে ক্ষুধার্ত করে তোলে তাঁর পরবর্তীর…

ছবির শুরু এবং শেষ এই দৃশ্যে। মাঝের সময়টুকু যা গল্প বলে তার চেয়ে ভাবায় অনেক অনেক বেশি।

Exit mobile version