ডিপ্রেশন ও মানবসভ্যতা:
(আজ দ্বিতীয় কিস্তি )
ডিপ্রেশনের সাথে মানবসভ্যতার সম্পর্ক খুব পুরোনো। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মেসোপটেমীয় নথিতে মানসিক অবসাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ডিপ্রেশনকে শুধুই মানসিক নয়,শারীরবৃত্তীয় সমস্যা হিসেবে প্রথম মেনে নেন গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটাস। লিখেছেন অমিতাভ দাষ।
Bengal Live স্পেশালঃ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে যদিও ডিপ্রেশনের ওপর উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও সুইস মনোচিকিৎসক কার্ল জং। এঁরাই প্রথমবার অবসাদের কারণ হিসেবে অবদমিত ইচ্ছা, কষ্ট, শিশুকালের সাথে এবং অবচেতন মনের সঙ্গে এর সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। অবসাদ সারাতে ব্যক্তির সাথে দীর্ঘ কথাবার্তা, শুধু অবসাদের লক্ষণগুলিই নয়, কারণগুলি খুঁজে বের করে রোগীকে জানানো—এইসব চিকিৎসা পদ্ধতির কথা এই দুজনই নির্দিষ্ট করেন, যা আধুনিক মনোচিকিৎসা জগতের ভিত্তি। পরবর্তীতে গবেষণা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ডিপ্রেশনের চিকিৎসাপদ্ধতির ও ওষুধের উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য এসেছে। সঠিক ওষুধের সাথে সাথে REBT,CBT,PIT, Gestalt, Hypnothera-py প্রভৃতি পদ্ধতির সঠিক ব্যবহারে প্রায় নব্বই শতাংশ অবসাদগ্রস্ত মানুষকে সম্পূর্ন সারিয়ে তোলা সম্ভব।
চিকিৎসার সমস্যা কোথায়?
ডিপ্রেশনের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমাদের অজ্ঞতা আর কুসংস্কার। আমরা শরীরের যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে,এমনকি মুখের ত্বকে একটু র্যাশ বেরোলেই ডাক্তারের কাছে ছুটি। কিন্তু দীর্ঘদিন মনখারাপ এবং সেই সংক্রান্ত সমস্যা উপেক্ষা করি। আমরা ভাবি, শুধুমাত্র পাগলেরই সাইকিয়াট্রিস্ট প্রয়োজন।তার উপর অবসাদ এমনই এক নীরব অসুখ যে, অনেকটা বেড়ে যাওয়ার পরই আমরা সেটা বুঝতে পারি, এর উচ্চতম লক্ষণগুলো দেখে। ফলে দেখা যায়, সাধারণ অবসাদ যখন Major Depressive Disorder-এ বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে পরিণত হয়, তখন বেশ দেরি হয়ে যায়। চিকিৎসা হয়ে যায় সময়সাপেক্ষ। একইসাথে চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ওষুধের ডোজ এবং থেরাপির ফলো-আপ ঠিকমত মেনে চলা হয় না। ভাবা হয়, ব্যক্তি সুস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু পরে আবার সমস্যা তৈরি হয়। অনেকে আবার থেরাপিস্ট বা ডাক্তারের কাছে অনেক সমস্যা, অতীতের গোপন তথ্য লুকিয়ে যান, ফলে আসল কারণের খোঁজ করা সম্ভব হয় না। সবসময়েই যে আপনাকে অতীতের গোপন কিছু জিজ্ঞেস করা হবে, এমনটা নাও হতে পারে। তবে প্রশ্ন করলে সেটার সত্যি উত্তর না দিলে চিকিৎসা বিঘ্নিত হয়।এটা মনে রাখতে হবে, যাঁরা ডিপ্রেশনের মতো মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা তথ্য গোপন রাখার শপথ নিয়েই পেশাতে আসেন। তাই এক্ষেত্রে তার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতেই হবে।
অনেকে পাড়া-পড়শী বা আত্মীয়-স্বজনের ভয়ে মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করান না। মনে রাখবেন, মস্তিষ্ক আমাদের শরীরের একটি অঙ্গ, চোখ, হাত, পায়ের মতোই। পেটখারাপ বা সর্দি হওয়া যেমন স্বাভাবিক, এটাও তাই।মস্তিষ্কের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও খুব স্বাভাবিক। এমনকি যাঁরা মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করেন, তাঁদেরও এই সমস্যা হয়। তাঁরাও অন্য থেরাপিস্ট এর কাছে যান। বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড়, লেখক,
অভিনেতা, নেতা, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, সুরকার থেকে শুরু করে বড় কোম্পানির CEO সবাই নিয়মিত থেরাপিস্টের ও প্রয়োজন পড়লে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান। গুগল্, সোনি, স্যামসাং, কোকাকোলা প্রভৃতি বড় বড় কোম্পানির ম্যানেজার ও কর্মচারীদের নিয়ম করে থেরাপিস্টদের কাছে পাঠানো হয়, কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও আমাদের দেশেও অনেক স্কুলে সব বাচ্চাদেরই বছরে এক বা দুই বার সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করা বাধ্যতামূলক।
আমি নিজেও তাই ভাবি – কে পাগল নয়? এই পৃথিবীতে, আমরা সবাই যারা মৃত্যুকে ভুলে প্রতিদিন বাঁচি, কাজ করতে করতে পরিবারকে সময় দিতে ভুলে যাই, আকাশে সূর্যাস্তের মিশতে থাকা রঙের খেলা ভুলে জোর করে কাজে মন দিই, টিভিতে খেলা দেখে বা আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করি, নিজের ভেতরে নিজেকে না খুঁজে বন্ধুত্ব আর সম্পর্কগুলোকে দাম না দিয়ে বাড়ি, গাড়ি, অর্থ –এইসবকে নিজের বলে ভাবি, ফেসবুকে যাই-ই দেখি না কেন, একটা না একটা মন্তব্য দিতে না পারলে হাত নিশপিশ করে।আমরা কি পাগল নই ??
একটু ভেবে দেখলে দেখা যাবে, মস্তিষ্কের সমস্যায় আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ভুগছি। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা একটু বেশি, এই যা।
কত রকমের ডিপ্রেশন হয়?
চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় অবসাদের লক্ষণ, কারণ, অবস্থা এসব ভীষণ জটিল ব্যাপার। DSM (The diagnostic and statistical manual for mental disorders, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক সংস্থান) এবং ISD (International classification of disease, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO দ্বারা কৃত) অনুযায়ী আমরা সহজভাবে যে কয়টি ভাগে অবসাদকে আলাদা করতে পারি সেগুলির থেকে আমি বিশেষ কয়েকটি বেছে নিলাম।
1.Major Depressive Disorder: একেই ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বলা হয় এবং এই অবসাদই অবসাদগ্রস্ততার শেষ দশা। এতে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। তবে আশার কথা হল যে, সঠিক এবং দীর্ঘ চিকিৎসায় MDD সম্পূর্ন সেরে যাওয়া সম্ভব।
2.CYCLOTHYMIA_ (সাইক্লোথিমিয়া): এটা সবচেয়ে সামান্যতম অবসাদ, যার ক্ষেত্রে খুব সামান্য সময় আর চিকিৎসা প্রয়োজন। ফেলে রাখলে এটাই কিন্তু অন্য রকমের অবসাদে পরিণত হয়।
3.DYSTHYMIA_ (ডিসথিমিয়া): এর প্রাবল্য সামান্যতম অবসাদের চেয়ে বেশি এবং কিশোরাবস্থায় এর সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু এক্ষেত্রেও খুব দ্রুত সেরে যাওয়া সম্ভব।
4.PMDD_ (ঋতুপূর্বকালীন অবসাদ): নারীশরীরে ঋতুচক্র শুরু হবার আগে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই অবসাদ হয়। সামান্য কিছু ওষুধ, জীবনযাপনে পরিবর্তন ও পরিবারের সাহায্যেই এই অবসাদ সেরে যায়।
5.Bipolar Disorder_ (বাইপোলার):
এটা একধরনের MDD যেখানে অবসাদ দশা ও সামান্য দশা মাঝে মাঝে অবস্থা পরিবর্তন করে। তার ফলে কখনো মনে হতে পারে ব্যক্তির অবসাদ নেই। কিন্তু হঠাৎ ব্যক্তি ভয়ঙ্করতম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। সেজন্য এর চিকিৎসা দীর্ঘসময় সাপেক্ষ। কিন্তু এক্ষেত্রেও সেরে যাওয়া সম্ভব।
এছাড়াও গর্ভাবস্থায় অবসাদ, গর্ভাবস্থার পরে অবসাদ, বৃদ্ধাবস্থায় অবসাদ, ঋতু পরিবর্তনে অবসাদ (SAD), হঠাৎ মানসিক চাপের ফলে হতে থাকা অবসাদ (PTSD) –এরকম অনেক ভাগ রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই কিছু কিছু লক্ষণ একই হতে পারে, আবার আলাদাও হতে পারে। আবার ব্যক্তিবিশেষে অবসাদের লক্ষণ আলাদাও হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ দেখেই অবসাদ হয়েছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। সব ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনেই চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ।
( পরের কিস্তিতে: কিভাবে বুঝবেন ডিপ্রেশন হয়েছে? নিজের বা পরিবারে কারো ডিপ্রেসন হলে প্রাথমিকভাবে কি করবেন )
লেখক অমিতাভ দাষ।
Child and adolescent counsellor,
Addiction counsellor, Certified Depression therapist
and psychotherapist.