কতটা ছুঁলে যৌনতা ? বোম্বে হাইকোর্টের রায়ের পরে উঠছে এই প্রশ্ন
বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের সাম্প্রতিক রায়ে সচেতন বাবা-মায়েদের চিন্তার কারণ বেড়ে গেল। যাঁরা শিশুদের ওপর যৌন নিগ্রহ নিয়ে সামান্যতমও খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন সাম্প্রতিক সময়ে কী পরিমানে শিশু ও বয়ঃসন্ধি ছেলেমেয়েদের যৌন হেনস্থার পরিমান বেড়ে গেছে ? লেখক: অমিতাভ দাষ।
Bengal Live স্পেশালঃ 24 শে জানুয়ারী। জাতীয় কন্যা শিশু দিবসের দিন সংবাদপত্রে এক ভীষণ খবর পড়লাম। বোম্বে হাইকোর্টের অন্তর্গত নাগপুরে একটি কেস এর রায়দানকালীন মাননীয়া জাস্টিস পুষ্প বীরেন্দ্র গানেডিওয়ালা বলেছেন যে “একমাত্র যৌন ইচ্ছা সম্বন্ধীয় কারণে নির্যাতিত ও উৎপীরকের ত্বকের সাথে ত্বকের সম্পর্ক হলেই সেটা যৌন নির্যাতন বলে গণ্য হতে পারে,নচেৎ নয়।সেক্ষেত্রে সেটা হয়রানি হলেও যৌন নির্যাতন নয়।“( ‘skin to skin contact with sexual intent’ )
বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের এই সাম্প্রতিক রায়ে সচেতন বাবা -মাদের চিন্তার কারণ বেড়ে গেল বললে খুব একটা বেশি বলা হবে না। যাঁরা শিশুদের ওপর যৌন নিগ্রহ নিয়ে সামান্যতমও খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন সাম্প্রতিক সময়ে কী পরিমানে শিশু ও বয়ঃসন্ধি ছেলে ও মেয়েদের যৌন হেনস্থার পরিমান বেড়ে গেছে ,অথবা ঘটনাগুলো মিডিয়া দ্বারা রিপোর্টেড হচ্ছে। 2012 সালের POCSO অ্যাক্ট ( Protection of children from Sexual Offences)-এর মাধ্যমে সেই সামাজিক সত্যতাকে স্বীকার করে তার একটা সমাধানসূত্র তৈরি করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।
এই কয়টি গুণ রপ্ত করতে পারলেই সন্তানের মানুষ হওয়ার পথ অপ্রতিরোধ্
এটা নিঃসন্দেহে আশার কথা যে ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে না।অথবা এ নিয়ে মেইনস্ট্রিম সিনেমাগুলিতেও চর্চা হচ্ছে, যেমন 2014 সালের ইমতিয়াজ আলী পরিচালিত, আলিয়া ভাট ও রণদীপ হুডা অভিনীত হাইওয়ে বা বিদ্যা বালান অভিনীত, সুজয় ঘোষ পরিচালিত সিনেমা কহানি- 2। কিন্তু শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদের ও সচেতনতার যে আগুন সমাজে জ্বলে থাকা উচিত, তার পরিপ্রেক্ষিতে বোম্বে হাইকোর্টের এই রায় যেন একবালতি ঠান্ডা জল।
বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের রায়ঃ
এনিয়ে সংবাদমাধ্যমে ঝড় উঠেছে। অনেক চর্চা, তর্ক শুরু হয়েছে। তথাকথিত নারীবাদীরা ও পুরুষবাদীরা বিভিন্ন ভাবে তাঁদের মতামত বিশ্লেষণ করবেন। কিন্তু সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারীর সাথে যৌন নির্যাতন এর সাথে একটি শিশুর ওপর করা যৌন নির্যাতনের যে ভীষণ পার্থক্য আছে, (যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুটি নিজে যেখানে যৌন শব্দটির মানেও জানে না) সেটা যদি কেউ বুঝতে পারেন তাহলে ওই বিচারক মহোদয়ার চিন্তাধারা বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে ,এ নিয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না হয়তো।
যে কেসের প্রসঙ্গে মাননীয়া বিচারক এই মতামত দিয়েছেন সেটি 2016 সালের একটি ঘটনা যেখানে নাগপুরের গিট্টিখাদান এলাকার একটি 12 বছর বয়সী মেয়েকে একজন 39 বছর বয়স্ক “মহাপুরুষ” পেয়ারার লোভ দেখিয়ে তার বাড়িতে ডেকে অত্যাচার করে। পুলিশের কাছে FIR কপিতে মেয়েটির সালোয়ার খোলা, বুকে হাত দেওয়া ও উৎপীড়ন করা ইত্যাদি লেখা ছিল।গত বছর অর্থাৎ 2020 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই মর্মে POCSO ও অন্যান্য ধারায় অভিযুক্তকে সেশন কোর্ট পাঁচ বছরের জেল ও পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করে।অভিযুক্তর তরফ থেকে সেই রায়ের পুনর্বিবেচনার ফসল 2021 এর এই হাস্যকর রায়। বিচারক মহোদয়া POSCO আইনের (8)আট নং,(10)দশ নং ও (12)বারো নং ধারাগুলি খারিজ করে ভারতীয় দণ্ডবিধির সেকশন-354-1 প্রস্তাব করেন। নাগপুর বেঞ্চ বলেন যে এই কেসটি sexual assault বা যৌন নিগ্রহের আওতায় পরে না। এটি একটি sexual harrasment বা যৌন হয়রানির উদাহরণ। এর ফলে অপরাধীর সর্বাধিক শুধু তিন বছরের কারাদন্ড হতে পারতো।
Internet : তথ্যের জালে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব, কীভাবে বাঁচাবেন ?
এত চিন্তার কারণ কী ?
POCSO আইন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইন, যেখানে এই সামাজিক সত্যতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, যে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের প্রসঙ্গ ও ধরণ সাধারণ যৌন নির্যাতন থেকে একদমই আলাদা।
POCSO এর সাত (7) নম্বর ধারায় আছে যে যৌন নির্যাতন তখনই গণ্য হবে যখন কেউ “with sexual intent touches the vagina, penis, anus or breast of the child or makes the child touch the vagina, penis, anus or breast of such person or any other person, or does any other act with sexual intent which involves physical contact without penetration is said to commit sexual assault”.
কিন্তু মাননীয়া বিচারকের আদালত এই “physical contact” শব্দটিকে “skin to skin contact” এর সমগোত্রীয় করে ছাড়ল।
আমরা শিশুদের গুড টাচ, ব্যাড টাচ শেখাই, যাতে তারা সহজেই বুঝতে পারে, তাদের কি উদ্দেশ্যে কেউ স্পর্শ করছে। ভারতীয় দন্ডবিধির 354 (Assault or use of criminal force to woman with intent to outrage her modesty ) ও 354-A (Sexual Harrasment) ধারার থেকে POCSO এজন্যই আলাদা যাতে সহজভাবে এবং স্পষ্টভাবে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের প্রকার বোঝা যায় ও অপরাধীকে দ্রুত শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়।
জানেন কি আপনার শিশু মিথ্যে বলে কেন ? জেনে নিন, সংশোধনের পথ খুঁজে পাবেন
কিন্তু সাম্প্রতিক এই রায় ভীষণভাবে POCSO আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে। শিশুদের উপর যে যৌন নিগ্রহ হয়, তার জন্য সবসময় পোশাক খোলার প্রয়োজন হয় না। বাস, ট্রেনে এবং বিভিন্ন জায়গায় আমরা যে সব যৌন নিগ্রহের কথা শুনি, সেখানেও কি সবসময় পোশাক খোলা হয়, না ত্বকের সংস্পর্শ হয়? সেরকম ভাবে বিশ্লেষণ করলে কনডোম ব্যবহারেও তো ত্বকের সাথে ত্বকের সংস্পর্শ হয় না।
এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে অপরাধী কাউকে জামা না খুলে যদি শরীরের সব অঙ্গ স্পর্শও করে , এই রায়ের উদাহরণ দিয়ে সেটাকে যৌন নির্যাতন আখ্যা দেওয়া যাবে না। অপরাধী পার পেয়ে যাবে। ভাবুন, কী ভয়ঙ্কর হবে! কাউকে নোংরাভাবে স্পর্শ করা, নোংরা ইঙ্গিত করা হয়ে যাবে অপরাধ বহির্ভুত সামান্য ব্যাপার। শিশুরা আরো বেশি পরিমাণে নির্যাতিত হতে থাকবে। রাস্তাঘাটে বাড়তে থাকবে এরকম অপরাধ।
আশার কথাঃ
একটাই আশার কথা এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে এবং এর উপর সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে। আপাতত জাস্টিস পুস্পার উপর বোম্বে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারক হবার সুপারিশও খারিজ হয়ে গেছে, এই রায়ের পর। এটর্নী জেনারেল কে কে বেণুগোপাল বলেছেন যে এই রায় একটি মারাত্মক উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে ( ‘likely to set a dangerous precedent’)
ইমোজির মানে না বুঝে ব্যবহার ? সাবধান ! ইমোজির পেছনে যৌনতার ব্যঞ্জনা
আশা করি মাননীয়া বিচারক পুষ্পাজির এই রায় কিছুদিনের মধ্যেই স্থায়ীভাবে খারিজ হয়ে যাবে। সমাজ বদলাচ্ছে,বদলাচ্ছে অপরাধীর চরিত্র ও মানসিকতা। সচেতন থাকুন।সন্তানদের সচেতন করুন। কিন্তু ভয় পাওয়াবেন না। এখনো আমাদের মধ্যে প্রচুর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও সচেতন মানুষ আছেন। তারাই আমাদের ভরসা।
লেখক: অমিতাভ দাষ।
(Child and Adolescent Counselor)