আন্তর্জালের ফাঁদে আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ আপনিই নষ্ট করছেন না তো ? ভাবুন
জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল কিংবা হালের সোশ্যাল মিডিয়া — সর্বত্র চলছে শিশুদের নানান রকম অডিশন। নাচে, গানে এমনকি মডেলিংয়েও কীভাবে স্মার্ট ও ফেমাস করে তুলবেন আপনার শিশুকে, সেই গাইডলাইনের অবিশ্রান্ত বিজ্ঞাপন।শিশুদের নির্মল শৈশব বলে কি আর কিছু আছে ? নাকি সে কেবলই একটি প্রোডাক্ট ? ভাবুন। ভাবা প্র্যাক্টিস করুন। লিখেছেন অমিতাভ দাষ।
Bengal Live স্পেশালঃ আট বছরের শ্রেয়সী। তার নিজস্ব facebook অ্যাকাউন্ট আছে। প্রায় পাঁচ হাজার ফলোয়ার। নতুন Instagram পেজেও যখন কিছু পোস্ট হয়, তার মা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন, কখন লাইক-এর সংখ্যা হাজার অতিক্রম করবে। তার বাবাকে প্রতিদিন আপিসের কলিগরা প্রশ্ন করেন, মেয়ের নতুন ভিডিও কবে আসছে ? এর পর কবে কোথায় অডিশন ? প্রশ্নবাণে তাঁকে ক্লান্ত করেন কলিগরা।
কিন্তু আপিস ফেরতা গর্বিত বাবা প্রায়ই মেয়ের জন্য নিয়ে আসেন ছোটখাট উপহার। শ্রেয়সীর অবশ্য like -এর সংখ্যায় কিছুই যায় আসে না। তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত আপিসফেরত বাবার ক্লান্ত মুখে হাত বুলিয়ে দেওয়া, বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে আদর খাওয়া। তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ ছবি আঁকা, রং করা। কল্পনার জাল জড়িয়ে তৈরি করা নতুন নতুন মায়াময় মূহুর্ত খেলা করে তার মাথায়। কিন্তু সময়ের অভাবে সেসব কাগজের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে না কখনো।
বাবা-মা ভাবেন, শ্রেয়সী বুঝতে পেরে গেছে , সপ্তাহে দুটি নাচের ভিডিও পোস্ট না করলে,আর নাচের অডিশনের প্র্যাক্টিস এর জন্য তার অন্য ভালোবাসার জিনিসগুলো ত্যাগ না করলে সে বড় হয়ে নাম করতে পারবে না এবং বাবা-মার মুখও উজ্জ্বল করতে পারবে না।
অন্যদিকে শ্রেয়সী ভাবে, বাবা-মা একদিন খুশি হয়ে শ্রেয়সীকে তার ভালোবাসা ফেরত দেবে। কোনো একদিন সে ঠিক সময় পাবে তার ক্যানভাসে রং মাখানোর। সে তাই মুখ বুজে কষ্ট করে যায় বাবা মার মুখে হাসি দেখার জন্য।
গভীর রাত অবধি চলে তার প্রাক্টিস। মায়ের ঘুম জড়ানো চোখে তার চোখের ছবি সে দেখতে পায় আবছা। কখনো মাথা টাল দিয়ে উঠলে সে দাঁতে দাঁত চেপে নেয়। বাইরে থেকে মনে হয়, সবই তো ঠিক যাচ্ছে, শ্রেয়সী ভালোই আছে। কিন্তু সময় গোপনে বীজ বুনে চলে bipolar disorder এর মত সমস্যার। যেখান থেকে হয়তো জন্ম নেবে ডিপ্রেশন, তারপর…….., তারপর……….!
আসলে সব কিছুই তো সেখানেই গিয়ে শেষ হবে , তাই না!!!!?
জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে জীবনটাই বৃথা, এরকম ভাবনাচিন্তা ছোটবেলা থেকেই ঢুকিয়ে দেয় সমাজ। আর বাবা-মা তো সমাজের বাইরে নন। তাঁরা তাঁদের নিজেদের না পাওয়ার যন্ত্রণা, যা সময়ের সাথে সাথে হতাশায় সুপ্ত ছিল, কিন্তু জেগে উঠেছে সন্তানের জন্মের পরই, তা পূরণ করার জন্য হয়ে ওঠে নির্মম।কিন্তু কিছু বছর আগেও এর চেহারা ছিল অন্য। বাবা-মা চাইতেন, সন্তান বড় হয়ে এমন কিছু করুক, যাতে গাড়ি-বাড়ি, টাকা-কড়ি চলে আসে হাতের মুঠোয়, তাই শুধু পড়াশোনার জন্য থাকত চাপ। তার সঙ্গে মেয়েদের শেখানো হত গান আর ছেলেদের ছিল ছবি আঁকা বা তবলা শেখা।সেখানে একদিন একটুআধটু ভুলচুক হলে মা বা গানের শিক্ষক ক্ষমাসুন্দর চোখে শুধু একটু তাকাতেন। আহা !বড় সুন্দর ছিল সেই দিন।
কিন্তু এখন দিন বদলেছে, বদলেছে ফোন। তাই এখন জন্মের পর থেকেই তোমাকে শিখতে হবে ক্যারাটে, গান, আবৃত্তি, নাচ, ব্যাডমিন্টন,
অঙ্কন। তোমার গান, নাচ দেখবে প্রাইম টাইমে তোমার রাজ্যের পনেরো লক্ষ আপিসফেরত আর রান্নাঘরফেরত কাকু-কাকিমনি। আর তোমার দিনরাতের প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করবে সেই অদৃশ্য সামাজিক মাধ্যম যা সেই ঈশ্বরকেও ক্ষমা করে না, যে ঈশ্বর ব্যবসা দিতে অক্ষম।
এই সর্বত্রব্যাপী পুঁজি নিয়ন্ত্রিত জগতের এক অদৃশ্য জালে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েন বাবা-মারা। যারা ভাবতে থাকেন, প্রথমত- সন্তানের সুখ লুকিয়ে আছে জাগতিক স্বাচ্ছন্দে।
দ্বিতীয়ত- নিজেদের অবহেলা করে সন্তানদের বড় করলে ইতিহাসের পাতায় শহীদের মর্যাদা পাওয়া যেতে পারে। তৃতীয়ত- ছোট থেকেই কম্পিটিশন করতে না শিখলে সন্তান ভবিষ্যতে পিছিয়ে পড়বে। চতুর্থত- ক্যামেরার সামনে বা হাজার চোখের সামনে পারফরম্যান্স দেখানোটাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। পঞ্চমত- সন্তানকে চালাক মানুষ হিসেবে তৈরি করতে হবে, তারা যাতে জানতে ও বুঝতে পারে পৃথীবিতে বাবা ও মা ছাড়া সবাই “দুস্টু লোক”।গুনে শেষ করা যাবে না এমন সব অদ্ভুত যুক্তি।
2000 সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান শিকাগো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেমস হেকমান। উনি নব্বই এর দশকে GED বা General Educational Development programme নামক একটি গবেষণায় প্রমাণ করেন যে cognitive ability যা দিয়ে আমরা IQ বা বুদ্ধিমত্তা মাপি, তার উচ্চমান সাময়িকভাবে একটি শিশুকে বুদ্ধিমান হিসেবে দেখালেও পরবর্তী জীবনে সেইসব শিশুর সাফল্যের হার বেশি যাদের মধ্যে কৌতূহল, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক পরিমণ্ডলে মেশার ক্ষমতা, দায়িত্বজ্ঞান, হার না মানার মানসিকতা, মায়াদয়া এসব বেশি।
এগুলোকে পরবর্তীতে নাম দেওয়া হয় EQ বা ইমোশনাল কোশন্ট। কিন্তু IQ মাপার ক্ষেত্রে এই গুণগুলোকে ধরাই হয় না। আমরা ভাবি বাচ্চাটি কত তাড়াতাড়ি পড়তে ও লিখতে শিখেছে, সে দারুন মুখস্থ করে পাতার পর পাতা বলতে পারছে কি না, সে অংক দারুন করছে কিনা, সে তথাকথিত smart কিনা, এসবই একটি শিশুকে গড়ে তোলে। কিন্তু আমরা বরাবরই ভুল ভেবে আসছি।
আমেরিকান লেখিকা সুজান কেন একটি খুব জনপ্রিয় বই “Quiet”এ বিস্তারিত ভাবে দেখিয়েছেন কীভাবে তথাকথিত “মুখচোরা, ক্যাবলা, আনস্মার্ট” শিশুরাই পরবর্তী জীবনে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছে সমাজ ও সংস্কৃতির গতিপথ নিয়ন্ত্রক হিসেবে।ইউরোপ ও আমেরিকায় তাই স্কুলগুলিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সৃষ্টিশীলতা, অনুভূতিপ্রবনতা, নিরপেক্ষতা, সাহায্যকারী মনোভাব….এইসব গুণাবলির বিকাশ যাতে হয়, তেমন পাঠক্রম তৈরি করার। Competition বা প্রতিযোগিতা নয় Co-operation বা সহযোগিতা হতে চলেছে একবিংশ শতকের সাফল্যের মূলমন্ত্র।
আসলে আধুনিক বাজার মনস্ক সমাজ দেখেছে, যেসব শিশুরা লাজুক, কম কথা বলে, ভাবুক তাদের থেকে যেসব শিশুরা পারফর্মার, ক্যামেরা ফ্রেন্ডলী তাদের দিয়ে বিক্রি বাট্টা বা advertising করানো বেশি ভালোভাবে সম্ভব। আর আজকের “হাম দো হামারা এক” মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে শিশুটির পছন্দই পরিবারের শেষ পছন্দ। তাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে শিশুদের দিয়ে ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে টুথপেস্ট এর বিজ্ঞাপন। যে বিজ্ঞাপনগুলোতে আগে স্বল্পবসনা সুন্দরীদের দেখা যেত সেই স্থানেই প্রমোশন হয়েছে আজকের যুগের শিশুদের। বাবা-মা খুশিমনে মেনে নিচ্ছেন এই উত্তরণের পথ।
বিখ্যাত হতে কে না চায়? কিন্তু শিশুটি হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রচালিত মানুষ, যাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে কম্পিটিশন নামক চালিকাশক্তি দিয়ে। যে শৈশবে মানব মস্তিষ্কের সবচেয়ে বেশি গ্রহন করার ক্ষমতা থাকে, সেই সময় আমরা নিজেদের অজান্তেই ভুল প্রোগ্রাম করে ফেলছি আমাদের ভবিষ্যতের সুপারডুপার কম্পিউটারদের। আগামী জীবনের জন্য তাদের রেখে যাচ্ছি অনিশ্চয়তা, ভয়, অবিশ্বাস, প্রতিযোগিতার কোলে। তার ফল বৃদ্ধাশ্রমে পিতার মৃত্যুর খবর পেয়েও ছুটে আসতে পারছে না সন্তান, নতুন প্রজেক্ট এর চাপে।
উপায় কি আছে? যেভাবে কম্পিটিশন বাড়ছে! এইসব বলে নিজেদের বোকা বানাবেন না। “ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন”।আপনার জীবনের না পাওয়ার শোধ আপনি শিশুটিকে দিয়ে তুলতে চাইবেন না। এই পৃথিবীতে নিজের বয়সের দাবিতে যতটুকু আনন্দ পাবার, কল্পনা করার, নিজের মত করে শেখার অধিকার থেকে আপনি আপনার শিশুকে বঞ্চিত করতে পারেন না। তার সাথে গল্প করুন পুরাণের। মহাপুরুষদের জীবনী শোনান তাকে, গল্প শুনুন তার মুখে।তাকে জানালা দিয়ে অবাক হয়ে তাকাতে দিন মিনিটের পর মিনিট ধরে, গাছের পাতা বেটে রং আর ওষুধ তৈরি করতে দিন তাকে, মাটি ঘাঁটতে দিন, দেয়াল জুড়ে আঁকতে দিন নতুন ভ্যান গোখ রং পেন্সিল, কুড়োতে দিন পাথর,পড়ে থাকা পাখিটার ভাঙা ডানা ব্যান্ডেজ করতে দিন। অঙ্ক বা জি কে হোমওয়ার্ক আজকের দিনটা পরে থাকুক টেবিলের অন্ধকার দিকটিতে।
অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা, সবসময় লাইমলাইটে থাকার ভয়ঙ্কর প্রবণতার শিকার হতে দেবেন না আপনার শিশুটিকে। অসাধারণ তারাই হয় যারা সাধারণকেও করে তোলে ম্যাজিক। বারবার ভুল করেও যারা হার মানে না নিজের কাছে, তাদের দরকার হয় না কোনো প্ল্যাটফর্মের।তারা নিজেরাই নিজেদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। আপনার সন্তান যেন শুধু একজন ভালো মানুষ, ভালো নাগরিক হয়, সবসময় এই শিক্ষা দিন তাকে।দেখবেন একদিন হয়ত হাজার হাজার ওয়াট চোখধাঁধানো আলোর পেছনে আপনি দাঁড়িয়ে থাকলেও সেইই তখন উজ্জ্বল আলোর বৃত্ত পেছনে ফেলে ছুটে এসেছে আপনার কাছে, জড়িয়ে ধরেছে। কারণ তার কাছে ওইসব কৃত্রিম আলোর থেকেও অনেক অনেক মূল্যবান আপনার চোখের তারার মৃদু বিচ্ছুরণ।
লেখক পরিচিতিঃ
অমিতাভ দাষ। শিক্ষক, Child and adolescent counselor,
Addiction counselor, Depression therapist
এবং Achology certified psychotherapist.