বেঙ্গল লাইভ Special

আপনি কি বোধহীন মাংসের স্তুপ? মোবাইল ফোন ও সম্মিলিত অচেতনতা

আপনি আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, না আপনার ফোন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ? আমাদের মস্তিস্কের পরিবর্তে কি এই যন্ত্র-মস্তিষ্ক মেনে নেবেন আপনি ? ডেকে আনবেন এক ভয়ংকর ভবিষ্যৎ ? আপনি কি তৈরি হচ্ছেন এক বোধহীন মাংসের স্তুপে ? একটু ভাবুন। লিখেছেন অমিতাভ দাষ।

Bengal Live স্পেশালঃ হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প মনে আছে? সেই যে , যার বাঁশির সুরে সমস্ত ইঁদুর ছুটে আসত, আর তার পেছনে ছুটতে থাকত। আসলে সবগুলো ইঁদুরই তার আগের জনকে দেখে দৌড়ত। ঠিক ভেড়ার পাল যেমনটি করে। ছোটবেলায় জীবনবিজ্ঞানের বইতে পড়তাম, প্রাণের ধর্ম চেতনা। মৃতরা অচেতন।তাদের জাগিয়ে তোলা যায় না। অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষের ক্ষেত্রে নিশ্চয় চেতনার অর্থ আলাদা। আমাদের চকচকে রাস্তা, পোশাক, স্কুল- কলেজ , হাতে আধুনিক স্মার্টফোন নিশ্চয় তাই বলে। মানুষের চেতনা শব্দটির সঠিক অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার কখনোই হত না, যদি না আমি পরবর্তীতে “বোধ” শব্দটি পড়তাম। আমার দু- দশ জন চেনাশোনা ব্যক্তির ( যাদের বয়স 16 থেকে 60) সাথে কথা বলে আমার ধারণা হয়েছে যে সাধারণভাবে আমাদের কী করা উচিৎ এবং কী করা উচিৎ নয়, সেই জ্ঞানটির নামই বোধ।

আরও পড়ুনঃ আন্তর্জালের ফাঁদে আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ আপনিই নষ্ট করছেন না তো ? ভাবুন

এভাবেও বলা যায় যে আমি কী করছি আর আমার কী করা উচিৎ ছিল, এটা ধরতে পারার ক্ষমতাই বোধ।

সুতরাং বলা যেতেই পারে বোধ অর্থ ব্যক্তিগত চেতনা। সবার ক্ষেত্রে এই বোধ ভিন্ন। কারণ আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই উচিৎ আর অনুচিৎ এর তালিকা ভিন্ন। একজন বিবাহিত দম্পতির কাছে যেগুলো উচিৎ, তা একজন অবিবাহিত ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে ভীষণরকম অনুচিৎ—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কিন্তু মানবচরিত্রের ধর্ম অদ্ভুত। ঠিক যা যা আমাদের মধ্যে যার যার করা উচিৎ নয়, সেগুলির অধিকাংশই আমাদের মন করতে চায়। ছাত্র- ছাত্রী ও শিক্ষক – শিক্ষিকাগণ ফাঁকি দিতে চায়, কেরানি ও অফিসার ঘুষ নিতে চায়, পুলিশ আর ইনকাম ট্যাক্স নিতে চায় অসরকারী চালান, নেতা ভোটের সময় ছাড়া অন্য সব সমস্যার সময় সবার পিছনে থাকতে চায়,—এ তালিকা অতি দীর্ঘায়িত হতে পারে। কিন্তু মোদ্দা কথা এই যে আমাদের নিজেদের কাজে কোনো মন নেই। কেউ নিজের কাজ সত্যিকারের মন দিয়ে করে না। তার প্রধান কারণ, সবার কাজের মূল লক্ষ্য- অর্থ অথবা সেই সব কিছু যা তাকে অর্থের মতোই বাহ্যিক সুখ দিতে পারে, শান্তি নয়। আর একটা কারণ, এরা কেউই নিজেদের কাজকে ভালোবাসে না। এদের কাছে এগুলো শুধুই কাজ।

আরও পড়ুনঃ ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির পথ, জেনে নিন বিশেষজ্ঞর পরামর্শ

এর সাথে বর্তমানে আর একটি নতুন কাজ আমাদের সবার অতি প্রয়োজনীয় তালিকায় যুক্ত হয়েছে। মোবাইল ঘাঁটা। আমার এক বন্ধু তার তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন । ছেলে ভীষণ জেদি হয়ে উঠেছে। লক ডাউনে বাবা ও ছেলে বাড়িতেই বন্দি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছেলে সারাদিনে কতক্ষণ মোবাইল ফোন ধরে? বন্ধুর অভিযোগ, ছেলে বাবাকে কাজে বিরক্ত করে, তাই তার হাত থেকে রেহাই পেতে সে তার স্ত্রীর ফোনটি সারাক্ষণ ছেলের কাছেই দিয়ে রাখে। আমি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ছেলে তাকে কোন কোন কাজে বিরক্ত করে? সে জবাব দিল, যখন বন্ধু মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে, সেই সময়গুলিতেই ছেলে তাকে বিরক্ত করে। বন্ধুকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ফোন করতে হয়। কলকাতা সহ রাজ্যের কয়েকটি জেলায় তার ব্যবসা ছড়ানো। এরপর আমি আরও গভীর প্রশ্ন করলাম।বন্ধুকে তার পুত্র কি ফোন করার সময় বিরক্ত করে? তাকে দিনে কতবার ফোন করতে হয়? উত্তর পেলাম “না, সেসময় নয়”। দিনে গড়ে দশ বার। তার মানে ব্যবসার কাজের সময় পুত্র তাকে বিরক্ত করে না। তাহলে ঠিক কখন বিরক্ত করে? উত্তর ,ফোন ঘাঁটার সময়। এবং খুব স্পষ্টভাবে বলতে হলে, সেটি কোনো প্রয়োজনীয় কাজের সময় নয়। অর্থাৎ বাবা ফোন ঘাঁটছে, ছেলে তাকে বিরক্ত করছে, তাই বাবা ছেলের হাতেও ঘাঁটার জন্য ফোন দিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ ডিপ্রেশন কাদের হয়, কখন হয়? জেনে নিন বিশেষজ্ঞর লেখায়

এখন বিভিন্ন ফোন কোম্পানি মাসে প্রায় পাঁচটি নতুন মডেলের ফোন বাজারে ছাড়ে। সময়ের প্রয়োজনে নতুন সংযোজন গেমিং ফোন। দুই বন্ধু দুই স্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে খেলতে পারে এসব গেম। সবথেকে বেশি জনপ্রিয় খেলাগুলি যুদ্ধক্ষেত্র সংক্রান্ত। বন্দুক, গুলি, বোম, রক্ত, মৃতদেহ এসব এই খেলাগুলির অবিচ্ছেদ্য অংশ।সাধারণভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা এই খেলাগুলির পেছনে দিনে প্রায় ছয় থেকে সাত ঘন্টা ব্যয় করে, নিশ্চয় খুব আনন্দ পায়। উচিৎ কি উচিৎ নয়, নিশ্চয় ভেবে তারা খেলে না। তাছাড়াও যারা এসব খেলেন না, তারাও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সারাদিন সুযোগ পান পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে যা যা খারাপ হচ্ছে, তা জানার, দেখার এবং মন্তব্য করার। ফলে না চেয়েও আমরা জড়িয়ে পড়ি অপ্রয়োজনীয় মন্দগুলির সাথে, যেগুলো আমাদের ভালো থাকাকে প্রভাবিত করে। যে যে বিষয়গুলি নিয়ে আমরা সারা বছরেও একবার আলোচনা করি না, সেই সব বিষয়ে তৎক্ষণাৎ মন্তব্য না করলে, আমাদের খাদ্য হজম হওয়া মুশকিল হয়ে যায়। উচিৎ, অনুচিৎ মনে থাকে না সে সময়।

আরও পড়ুনঃ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে কী করবেন ? জানুন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। তৃতীয় কিস্তি।

এইভাবেই আমাদের মধ্যে যা জন্ম নিচ্ছে, তা হলো “সম্মিলিত অচেতনতা”। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় collective-unconciousness,যদিও এই শব্দবন্ধটির জন্মদাতা কার্ল গুস্তাভ জঁ,1940 এর দশকে।

কিন্তু বর্তমান সময়ে কি দারুণভাবে দেখা যাচ্ছে আমরা ব্যক্তিগত সচেতনতার পরিসর ছেড়ে অদ্ভুত নেশায় সম্মিলিত ভাবে অন্য এক সচেতনতার মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছি। ব্যক্তিগত উচিৎ অনুচিৎ এর গন্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছি কোথায়; নিজেরাই জানিনা।

আমাদের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করছে যন্ত্র আর সমস্ত ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে বাজারগত। আমাদের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা চলে যাচ্ছে অন্যের হাতে। আমাদের ধর্ম, রাজনীতি, খাওয়া-দাওয়া, জামা-কাপড় এমনকি সাবান- টুথপেস্ট অবধি আমরা কিনছি না, আমাদের কেনানো হচ্ছে; আমরা বুঝতেও পারছি না। আমাদের মূল্যবান সময়গুলো আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি, হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছি মানসিক হাজার সম্ভাবনা। ভাবতে ভুলে যাচ্ছি, ভুলে যাচ্ছি গল্প করতে বা শুনতে। সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলির ক্ষমতা লুপ্ত করছি ক্রমে ক্রমে।

প্রচুর এড্রেনালীন, ডোপামিন হরমোন লাগাতার ক্ষরণের ফলে আক্রান্ত হচ্ছি ভয়ঙ্কর এক নেশায়, যার থেকে মুক্তি নেই, শুধু আছে আরো আরো খেলার, ঘাঁটার হাতছানি। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে দামি মোবাইলে ফেস আনলক করতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছি যন্ত্রের গভীর ভার্চুয়াল বাস্তবে, যার সঙ্গে পৃথিবীর বাস্তবের কোনো মিল নেই।

আরও পড়ুনঃ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি ? জেনে নিন লকডাউনে আপনার শিশুর মন খারাপের দাওয়াই, ভাল থাকার উপায়

এর ফলে জন্ম নিচ্ছে জীবনে অনর্থক জটিলতা, অন্যের সাথে নিজেকে ক্রমাগত তুলনা করার প্রবৃত্তি, অসন্তোষ, স্ট্রেস যা ক্ষয় করে চলেছে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিকতাকে। জন্ম নিচ্ছে একের পর এক অসুখ, রক্তচাপ বৃদ্ধি থেকে ব্লাডসুগার, হার্টের সমস্যা থেকে ডিপ্রেশন ,আরো নানা রোগ।

দামি মোবাইল ফোন নিয়ে আপনি ভাবছেন আপনি সুখী। কারণ বিজ্ঞাপনে মোবাইলটির সাথে আপনি সুখী মুখ দেখেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সুখ এবং আনন্দ আপনি পাচ্ছেন কি না, বা আপনার মোবাইলটি ক্রমে ক্রমে আপনারই সুখের অন্তরায় হয়ে উঠছে কি না, সেটা হয়তো ভেবে দেখার সময় হয়েছে এবার।

মনে রাখবেন, যদি আনন্দে থাকতে চান, নিজের ধারণাগুলি সবার আগে বদলাতে হবে। এটা করতে হবে সচেতনভাবে, ধীরে ধীরে ,সময় নিয়ে। বাইরের শক্তির প্রভাব যাতে আপনার মনের উপর না পড়ে, সেজন্য ধ্যান অভ্যেস করতে হবে। এটুকু পড়েই ভাবছেন আর পড়বেন না, তাইতো? ধ্যান করার সময় কোথায় আমাদের?

আপনি যখন ভাত খাচ্ছেন, তখন কোন তরকারির সঙ্গে কতখানি ভাত মেখে কী স্বাদ পাচ্ছেন, সেটা ভালোভাবে বুঝতে যদি পারেন, ভাববেন আপনি ধ্যান করে ফেলেছেন নিজের অজান্তেই। ভাবুন তো, ঠিক কতদিন আগে আপনি ভাত খাবার সময় শুধুই ভাত খেয়েছেন, অন্য কিচ্ছু করেননি ,যেমন টিভি দেখা, গল্প করা, পেপার পড়া, সর্বোপরি মোবাইল ফোনটি ঘাঁটা। তার মানে আপনি মন দিয়ে ভাত খাননি।

আরও পড়ুনঃ করোনা – বায়োলজি, বিশ্বপুঁজির খেলা এবং আমাদের অস্তিত্ব

যে কোনো কাজ, তা আপাতভাবে যতই তুচ্ছ বলে মনে হোক, সম্পূর্ণ মনযোগ দিয়ে করলেই ধ্যানের সুফল পাওয়া যায়। এটা আমার কথা নয়।স্বামী বিবেকানন্দ তার “কর্মযোগ” প্রবন্ধে বলেছেন। আর আপনি আর আমি যে ভাবি ,ভাত খাওয়াটা খুব একটা জরুরি কাজ নয়, অদ্ভুতভাবে আমাদের শরীরের ভালো মন্দ নির্ভর করে, আমরা কি খাচ্ছি? কখন খাচ্ছি? এবং কিভাবে খাচ্ছি ? তার উপরেও।

একই রকমভাবে আপনার শিশুটির সঙ্গে খেলাও ধ্যান,স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করাও ধ্যান, আর মন দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারাও আসলে ধ্যান, যদি তা আপনি একমনে করতে পারেন। মোবাইল না ঘাঁটতে ঘাঁটতে।

তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনি কি আপনার একমুখী কাজের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন? নাকি আপনার মোবাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে আপনার প্রতিটি ধ্যান থেকে দূরে সরাতে চাইছে। আপনি কি ব্যক্তিগত বা নিজ সচেতনতায় চেতনাযুক্ত মানুষ হবার পথে হাঁটতে চান। নাকি হয়ে যাচ্ছেন এক চেতনাহীন, বোধহীন সম্মিলিত-অচেতন এক প্রাণী, অন্যান্যদের মত, যাদের সবাই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার পেছনে দৌড়াচ্ছে, বড় নদীটিতে লাফ দিয়ে মরবে বলে, শুধুমাত্র এজন্যই , যে সবাই সেদিকেই যাচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ মুর্শিদাবাদের পঞ্চরস আলকাপ ও চরের জ্যোৎস্নায় দুই উলঙ্গ কিশোরের সংলাপ

সাধারণ কয়েকটি বোধবৃদ্ধির উপায়ঃ

একঃ সব নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন। ফোন আপনাকে জ্বালাবে না।

দুইঃ শুধু রাতে সোশ্যাল মিডিয়া খুলুন। এর ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট করে দিন।

তিনঃ প্রয়োজন ছাড়া সব বিষয়ে কমেন্ট দেওয়া বন্ধ করুন।

চারঃ খুব অচেনা কারো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট নেবেন না।বন্ধুর সংখ্যা কম রাখুন।

পাঁচঃ শোবার ঘরে ফোন রাখবেন না।বিছানার পাশে তো নয়ই।

ছয়ঃ উপরের পাঁচটি পনেরদিন মন শক্ত করে চেষ্টা করুন,দেখবেন অভ্যাস হয়ে গেছে।

অমিতাভ দাষ।
Child and adolescent counsellor,
Addiction and depression counsellor,
Certified Psychotherapist.
Whatsapp:7001596757

Related News

Back to top button