রায়গঞ্জ করোনেশন হাই স্কুল, শতাব্দী পেরিয়ে শিকড়ের খোঁজে
উত্তর দিনাজপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় করোনেশন হাই স্কুল। পঠনপাঠন ও পরীক্ষার ফলাফলে আগাগোড়াই জেলা তো বটেই , কখনও কখনও উত্তরবঙ্গ তথা রাজ্যের মধ্যেও প্রথম সারিতে থেকেছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের অতীত ও আবেগ জড়িয়ে আছে এই বিদ্যালয়ের সাথে। লিখেছেন ডঃ বৃন্দাবন ঘোষ।
গোড়ার কথাঃ
সেই সময় অবিভক্ত বাংলার কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তি জাতীয় শিক্ষার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং তাঁদের উদ্যোগে ও দানে দিনাজপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ , কুমিল্লা, মালদহ সহ বিভিন্ন স্থানে পাঁচশােটির মতাে ম্যাট্রিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। রায়গঞ্জের কুলদাকান্ত ঘােষ , মথুরা চট্টোপাধ্যয়, উমেশ চন্দ্র ভৌমিক, চন্দ্রমােহন সাহা, নীলমােহন সাহা প্রমুখের উদ্যোগে ১৯১১ সালে রায়গঞ্জ করােনেশন হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা হয় । ১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত তাঁর রাজ্যাভিষেক (coronation )-এর ঘটনাকে মনে রাখার জন্য এই বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছিল রায়গঞ্জ করােনেশন হাইস্কুল।
বর্তমান রায়গঞ্জ করােনেশন হাইস্কুলের হস্টেল প্রাঙ্গণে ১৯০৫ সালে গড়ে উঠেছিল রায়গঞ্জ এম ই স্কুল। সেখানেই দুই-তিনটি চুন-সুরকি নির্মিত ঘরে রায়গঞ্জ করােনেশন হাইস্কুলের পঠন পাঠন চলতাে। ১৯১১ সালের ১৬ ই জানুয়ারী বর্ধমান জেলার বালিয়ারী গ্রাম থেকে বিভূতি ভূষণ অধিকারী এসে এই বিদ্যালয়ে প্রথম সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ রায়চৌধুরী এই বিদ্যালয়ের বাড়িঘর নিমার্ণের জন্য জমি দান করেন এবং সরকার থেকে ১৩০০০ টাকা পাওয়া যায়। তার পরেই ১৯১৩ সালে বিদ্যালয় তার নিজস্ব জমির উপরে বর্তমানে মূল প্রবেশপথের ডানদিকে টিনের চালের কয়েকটি নতুন ঘরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৪ সালে এই বিদ্যালয় প্রথম হাইস্কুল হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি (মেমাে নং- ১৭ , ডেটেড ১.৭.১৪ অফ ইউনিভারসিটি অফ কলকাতা ) লাভ করে। পরবর্তী কালে এই প্রতিষ্ঠান বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী, সেইল, সর্ব শিক্ষা মিশন সহ বিভিন্ন মহল থেকে বহু আর্থিক অনুদান লাভ করে। সেই অর্থ দিয়ে সাংস্কৃতিক মঞ্চ, পরীক্ষাগার, গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ, স্টাফ কোয়ার্টার গড়ে ওঠে ।
উন্নয়নের পথে সারথি ছিলেন যাঁরাঃ
অমৃত লাল দাশগুপ্ত ( ১৯১১ ) , দামােদর প্রামাণিক ( ১৯২০ ) , হেমন্ত কুমার, শশীন্দ্র চন্দ্র দে ( ১৯৪৪ ) , অমরেন্দ্র নাথ দাস ( ভারপ্রাপ্ত ১৯৬৯ ) , নীরেন্দ্র নাথ চাকী ( ১৯৭১ ) , দিলীপ কুমার নাগ ( ১৯৭৭ ) , চঞ্চল ব্যানার্জী ( ১৯৭৯ ) , শুভেন্দু মুখার্জী প্রমুখ প্রধান শিক্ষক এবং কুলদাকান্ত ঘােষ , সুরেশ চন্দ্র সেন , যােগীন্দ্র কুমার দে , হরেন্দ্র কিশাের চক্রবর্তী, গােবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তী , কুল চন্দ্র মিত্র , শ্যামাপ্রসাদ বর্মন , নির্মল চন্দ্র ঘােষ, বনমালী দাস , পৃথবীশ চন্দ্র মিত্র , জীতেন্দ্ররাম বক্সী , মােহিত সেনগুপ্ত প্রমুখ সম্পাদকের নেতৃত্বে ও কর্মকুশলতায় এই বিদ্যালয়ের প্রভূত উন্নতি ঘটে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম দিকে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ , রায়গঞ্জ গার্লস হায়ার সেকেন্ডারী স্কুল ও রায়গঞ্জ বি . এড কলেজের ক্লাস হতাে। দামােদর প্রামাণিকের আমলে ১৯২২ সালে এই বিদ্যালয় সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত ( গ্রান্ট – ইন – এইড ) বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে । সেই সময় বাড়ীঘর ও হাষ্টেলের উন্নতি ঘটে। পরীক্ষার ফল ও খেলাধুলায় সুনাম অর্জন করে । ডি.পি.আই মিঃ স্টেপল্টন সাহেব বিদ্যালয় পরিদর্শন করে তাঁর কর্ম প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে রায় সাহেব উপাধি দেওয়ার সুপারিশ করেন এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায় সাহেব উপাধিতে ভূষিত করে ।
শশীন্দ্র চন্দ্র দে – র আমলে প্রধান ভবন , শিক্ষক আবাস , নতুন ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে এবং পরীক্ষার ফলাফল ভালাে হয়। তাই ১৯৬০ সালে এই বিদ্যালয়কে একাদশ শ্রেণীর পঠন পাঠনের সরকারী অনুমতি ( মেমাে নং- ওআর / ৫৯ / ৪৬২৩ / জি , ডেটেড ৩০.৩.৬০ ডবলুই এফ ১.৪.৫৮ ) দেওয়া হয়। নীরেন্দ্র নাথ চাকীর সময়ে উত্তর দিকের ভবন , আঙ্গিনা প্রাচীর তৈরী হয় এবং বিদ্যালয় দ্বাদশ শ্রেণীতে উন্নীত ( মেমাে নং ৩৩৩৭ রেকগনাইজড : ডেটেড ৮.৭.৭৬ ডবলুই.এফ ১.৭.৭৬ ) হয় । চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে উত্তর দিকের দালানের দ্বিতল ভবন তৈরী হয়। বিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপটিকে স্টেজ হলে রূপান্তরিত করা হয়। বাণিজ্য বিভাগের অনুমতি মেলে এবং বহু সংখ্যা শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়ােগ হয় । শুভেন্দু মুখার্জীর সময়ে ইন্দিরা ভবন , জে . সি . বােস ব্লক অফ সায়েন্স , বিধান মঞ্চ , বহিঃপ্রাঙ্গণে নেতাজী ভবন , সংখ্যালঘু হাষ্টেল, গান্ধী নেতাজী রবীন্দ্রনাথের মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালাে। শতকরা কুড়ি শতাংশ ছাত্রছাত্রীর আশি শতাংশের উপরে নম্বর থাকে । শশীন্দ্র চন্দ্র দে ও শুভেন্দু মুখার্জীকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রদান করা হয় ।
হালের হালহকিকত ও কৃতী পড়ুয়ারাঃ
অতীতে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্ররা এই বিদ্যালয়ে পড়তে আসতাে । দূর – দূরান্তের বহিরাগত ছাত্ররা হস্টেলে থাকতাে । বর্তমানে কালিয়াগঞ্জ , ইটাহার , রায়গঞ্জ শহর ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে ছাত্রছাত্রী আসে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের তথ্য অনুসারে বিদ্যালরেয় স্থায়ী শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা ৪২ জন এবং ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৭০০ জন । কেবলমাত্র একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে মেয়েরা পড়ে । তপশীলি জাতি উপজাতি ও সংখ্যালঘু থেকে সাধারণ সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশী । এদের পরনে থাকে নেভী ব্লু ও আকাশী রঙের পােষাক । ১৯১৫ সালে এই বিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা প্রথম ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসে কৃতিত্বের পরিচয় দেয় । বিদ্যালয় থেকে ১৯২৪ সালে দশজন এবং ১৯২৯ সালে নয়জন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয় । ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ১৯২৪ সালে জহরলাল ঘােষ , ১৯২৮ সালে আব্দুল গফুর মহম্মদ , ১৯৩৫ সালে হিমাংশু শেখর ব্যানার্জী , ১৯৩৭ সালে সুশীল কুমার সিদ্ধান্ত এবং ১৯৩৯ সালে ব্রজ রাখাল দত্ত বৃত্তি পেয়েছিলেন । এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বরাবর প্রশংসনীয় ।
রাজা বসাক , দেবাশিষ সাহা , সুজয় ভৌমিক , অর্ণব সিংহ , রামকৃষ্ণ সাহা , অরিন্দম রায়চৌধুরী , গ্রেটা ঘােষ , দেবাশীষ সাহা , সাম্য মিত্র , স্নেহাশীষ কুমার ভক্ত , শােভন দেব , মৌনদীপ সাহার মতাে বহু ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান করে এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করে । লেখাপড়ার সাথে সাথে খেলাধুলায় সুকুমার সিদ্ধান্ত , অণু চৌধুরী , সুভাষ ভৌমিক , সুশীল ঘােষ , রবি ভৌমিক , শচীন বসু প্রমুখ কৃতিত্বের পরিচয় দেন । ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে এই বিদ্যালয় দশবার জেলা স্কুল ক্রীড়া প্রতিযােগিতায় শিক্ষক অরুণ চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে যােগ দিয়ে সাতবার চ্যাম্পিয়ানের শিরােপা লাভ করে ।
তথ্যসূত্র : স্মরণিকা , ২০১২ , রায়গঞ্জ করােনেশন উচ্চ বিদ্যালয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : প্রবীর পাল , তিলক তীর্থ ভৌমিক (সহকারী শিক্ষক) , অমল মিত্র (প্রাক্তন শিক্ষক), করােনেশন উচ্চ বিদ্যালয় ।