পরীক্ষায় তো নম্বরের বন্যা, কিন্তু জীবন বইবে কোন খাতে ? পড়ুন, ভাবতে সাহায্য করবে
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে নম্বরের বৃষ্টি। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কি তাদের পাওয়া মার্কশিটের মতোই রঙিন ? বাঙালির ভবিষ্যৎ কাদের হাতে? _লিখেছেন_ অমিতাভ দাষ।
Bengal Live স্পেশালঃ মাত্র কিছুদিন হলো মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক সহ CBSE বোর্ডের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় সবাই আশানুরূপ ফলাফল করেছে। কেউ কেউ হয়ত কোনো বিষয়ে একশো পেয়েও ভাবছে, কী কী ভুল হয়েছিল, যা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কেউ কেউ ভীষণভাবে চেষ্টা করছে চোখে মুখে যাতে কোনোভাবেই বিস্ময় না ধরা পড়ে। অনেকে ভাবছে কেন পড়াশুনার সাথে সাথে এইসব অভিনয় শেখানো হয় না আগে থেকে? এই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিও নম্বরের বরসাত দেখে কিছুটা লজ্জিত।
না! এতে ছাত্র-ছাত্রী দের কোনো দোষ নেই। এতে বোর্ডের বা মার্কশিট যে যে প্রিন্টারগুলোতে ছাপা হয়েছে, তাদেরও কোনো দোষ নেই। দোষ “চাইনিজ জীবাণুর”। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , এই এত এত নম্বর কি সবার কাজে লাগবে? পরীক্ষা নেবার নিশ্চয় একটা উদ্দেশ্যে ছিল। সেই উদ্দেশ্য কি পূরণ হবে? লাখ লাখ ছেলেমেয়ে তাদের প্রিয় ও ভালোলাগা বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে তো?
এটা একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু এর সাথে সাথেই আরো কিছু প্রশ্ন মাথায় এসে ভিড় করে আমাদের মত অকর্মন্যদের, যারা করোনায় মৃতের সংখ্যা গোনার জন্য সারাদিন টিভি চালিয়ে চোখ ও কানের পরিশ্রম করার সাহস দেখাতে পারেনি। এই সাধারণ মূর্খতা নিয়ে আমি একজন ব্যর্থ বাঙালি। তাই শুধু বাঙালিদের ব্যাপারেই আলোচনা করব। ভারতবর্ষ ও তার বাইরের পৃথিবীর সম্পর্কে অন্য পরিসরে ভাবা যাবে। প্রশ্নগুলির সার হলো এই:
প্রথমত: আজও, এই 2020 সালেও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং অতি উচ্চ সাধনার ফলে প্রাপ্ত অতি উচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশ শুধুমাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য দৌড়াচ্ছে কেন?
দ্বিতীয়ত: একবিংশ শতকে এবং আগত সময়ে পৃথিবীর ব্যাপক, ব্যাপক সমস্যাগুলো ( পরিবেশ বিষয়ক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি) যাদের চোখে সবচেয়ে বেশি পড়ার কথা এবং সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করার কথা ও সেগুলি থেকে মুক্তি কিভাবে পাওয়া যায় তা ভাবার কথা, সেই কৃতি ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলো নিয়ে কাজ করার ভাবনা ভাবছে না কেন?
তৃতীয়ত: কেন খুব,খুবই কম ছাত্র-ছাত্রীরা সিলেবাস এর বাইরের বই পড়ছে? তাদের পিতা-মাতারা কি তাদের উৎসাহিত করছেন না?
তিনটি প্রশ্নই কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।
প্রথমত: বাঙালিরা ভাবেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার রাস্তাটি অপেক্ষাকৃত সোজা। খুব কম সময়েই অর্থ রোজগার শুরু করা সম্ভব। নিশ্চিন্ত একটা ভবিষ্যতের হাতছানি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম আছে বৈকি। তবে আজ থেকে দুই বা তিন দশক আগেও মধ্যবিত্ত পরিবারে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্নের কোনো পরিবর্তন আজকেও, এই পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোর মধ্যে এনে ফেলা সময়েও, হয়নি। এটা নিশ্চই বাঙালির চিন্তা ও স্বপ্নের দৈন্যতা।
দ্বিতীয়ত: আজ এই ইন্টারনেট ও 5G (আগতপ্রায়) এর যুগেও বই ও নোট মুখস্থ করেই দিন ও নম্বরের সাগর পার করে দেওয়া বাঙালি তার দূরদৃষ্টির শ্রাদ্ধ করে ফেলেছে। অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এখনই অতীত। অতীত অশোক সেন, মীনাক্ষী ব্যানার্জি, কৌশিক বসুরাও। আগামী পঞ্চাশ বছরেও তাদের মত কেউ আর ফিরে আসবেন না বলেই মনে হয়।আজকের গর্বিত বাঙালি গতকাল ও আগামীকালের কথা ভাবে না।
তৃতীয়ত: মা-বাবাও আজ চান, ছেলেমেয়ে শুধু নম্বর আনুক। ক্রিকেটের মত এখানেও যে স্কোরবোর্ড খুবই বোকা, সেটা তারা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি।
অধিকাংশ বাঙালির ঘরে এখন সিলেবাসের বই ছাড়া অন্য কোনো বই পাওয়া দুস্কর। তার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, SSC প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া আজকের বাঙালি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে, বিজ্ঞানচর্চায়, রাজনীতিতে, সিনেমায়, আমলাতন্ত্রে, একদা নির্ভয়ে বিচরিত, বহুল-চর্চিত কৃতি বাঙালী ছাত্ররা এখন শুধু হাসপাতাল আর নার্সিং- হোমে গলায় স্টেথোস্কোপ শোভিত। আর তার যা দৈন্যদশা যে পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলিতে নিদেনপক্ষে বাধ্য না হলে, কেউ গোড়ালি অপারেশন করাতেও ভয় পান।
এই দৈন্যদশার দায় তবে কার? কেন স্কোরবোর্ডের নম্বর বৃহৎ জীবনে, সমাজ বদলে প্রতিফলিত হয় না?
মনস্তাত্তিকরা‘মেটাকগনিশন’(metacognition) নামে একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে, যার মোটামুটি অর্থ কী চিন্তা করছি সেই বিষয়ে চিন্তা করা। মানে সোজা ভাষায় দাদা কী করছেন? এর উত্তর : কী আর করব?কী ভাবব সেটাই ভাবছি? কিন্তু metacognition এক দুর্দান্ত জিনিস।একমাত্র মানুষেরই এই ক্ষমতা আছে বলে এখনো পর্যন্ত জানা গেছে।(ডলফিনদের আছে কিছুটা) এটা একটা এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট যেটা শেখানোর আদর্শ সময় বয়:সন্ধি কাল পূর্ববর্তী সময় এবং তার আশেপাশের সময়টুকু।
এই ক্ষমতা বাড়লে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে কোনো বিষয়ে ঠিকমত প্ল্যানিং ও সেটা কাজে পরিণত করার ক্ষমতা বেড়ে যায়।তখন সুনির্দিষ্ট বিষযে ভাবার অভ্যাস তৈরি হয়। আমি জীবনে কী হব, সেটা না ভেবে আমি জীবনে কী কী করব, সেটা ভাবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সুচিন্তিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার প্রবণতা বাড়ে। অর্থাৎ আমি ডাক্তার হব, এরকম না ভেবে সে ভাবতে শুরু করবে, আমি ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করতে চাই। আমি এমন একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, যে এই পৃথিবীর যাবতীয় প্লাস্টিকগুলো কিভাবে নষ্ট করা যায়, বা অন্যভাবে কাজে লাগানো যায়, সে পদ্ধতি চিন্তা করব।
ডেভিড লেভিন, মার্টিন সেলিগমান, এঞ্জেলা ডাকওআর্থ প্রমুখ মনস্তাত্ত্বিক ও লেখকরা তাদের প্রচুর পরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, এসময়ে পরীক্ষায় নম্বরের থেকে অনেক বেশি দরকার মেটাকগনিটিভ মানসিকতা তৈরি করা। তাতে ভালো ছাত্রদের নম্বর হয়তো দুই এক শতাংশ কমবে, কিন্তু তার পরিবর্তে তারা যা পাবে, সেগুলোই থাকে অমর্ত্য সেনের মত একজন নোবেল প্রাইজ প্রাপকের মানসিকতায়, দেবী শেঠীর মত একজন চিকিৎসকের দৃঢ় বিশ্বাসে, মনি ভৌমিকের মত একজন হার না মানা বিশ্ববরেণ্য পদার্থবিদের কপালের ভাঁজে।
আপনার সন্তানকে নোট মুখস্থ করার ফাঁকে, কখনো কি শুনিয়েছেন তারা ছোটবেলা থেকে কিভাবে বড় হয়ে উঠেছিল ???
অমিতাভ দাষ।
Child and adolescent counsellor,
Addiction and depression counsellor,
Certified Psychotherapist.
Whatsapp:7001596757