বন্ধু-বান্ধবী ও যৌনতা নিয়ে শিশুর মনের কৌতুহল কীভাবে সামলাবেন বাবা-মা ?
ছয় বছর থেকেই শুরু হওয়া উচিৎ সন্তানকে শাসন। শাসনের মাধ্যমেই বাঁচিয়ে রাখুন তার শৈশব। আজ তৃতীয় ও শেষ পর্ব।লিখেছেন শিশু মনস্তত্ববিদ অমিতাভ দাষ।
তৃতীয় পর্ব:
ছয় থেকে বারো:
শৈশব একটা মিষ্টি সময়।নির্দোষ-নিষ্পাপ শৈশব। সরল -সাবলীল শৈশব। এ সময় বাচ্চারা যা করে, না জেনেই করে; যা বলে, না ভেবেই বলে। যা শোনে, তা না বুঝেই শিখে ফেলে। কিন্তু তার ফল তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। তাই সাধারণত পাঁচ-ছয় বছরের পর থেকেই সন্তানকে স্নেহের সাথে সাথে শাসনের বেড়াজালে বেঁধে রাখাও দরকার।ছয় থেকে বারো (মোটামুটি ১৫ বছর অবধি) বছর বয়সটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি শিশুর চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে। এটাই তাকে শাসন করার, ভয় দেখিয়ে শুধরানোর চেষ্টা করার, বেত হাতে নেবার বয়স। কারণ এর পর সন্তানের সাথে বন্ধুর মত মিশতে হয়। কিন্তু তাই বলে কি ছয় বছর থেকেই তাকে ভীষণ রকম শাস্তি দেওয়া উচিৎ , সে কিছু দুস্টুমি করলে শুধু বকা দেওয়া উচিৎ, নাকি তার এক দুইটি অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়াই শ্রেয় ? বাবা–মা রা কিন্তু এই নিয়ে খুব সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
কেমন শাসন, কেমন বারণ:
আজকালকার শিশুরা আমাদের মতন নয়। এটা স্মার্টফোনের যুগ, বাচ্চারাও তাই স্মার্ট। আর স্মার্ট বাচ্চাদের সামলাতে বাবা – মাদেরও হতে হয় অনেক বেশি স্মার্ট। আমরা যখন ছোট ছিলাম, বড়দের ভয় পেতাম ভীষণ, কিন্তু এখনকার বাচ্চারা সেরকম নয়। অন্যদিকে এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি যুক্তিবাদী, তর্কবাগীশ। তাই তাদের ক্ষেত্রে শাসন করার পদ্ধতি আগের মত থাকলে চলবে কেন?
কোনো ব্যাপারে বাচ্চাদের মানা করতে হলে তাকে ডেকে ভালো করে যুক্তি দিয়ে বোঝান, কেন সে যে কাজটি করতে চাইছে বা করেছে , সেটা ঠিক নয়। তাকে পরিষ্কার বলুন, তার মত বুদ্ধিমান শিশুর কাছে এটা কখনোই আশা করা হয়নি; ভবিষ্যতে সে এটা কখনোই আর করবেনা, তা আপনারা এবং সেও নিশ্চই জানে। পরবর্তীতে সে একই জিনিস দ্বিতীয়বার করলে, তাকে ডেকে বকুন, এবং স্পষ্টভাষায় বলুন , সে যেটা করেছে, সেটা সে ভুল করেছে, তার জন্য তার শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু আপনারা তাকে ভীষণ ভালোবাসেন এবং বিশ্বাস করেন, তাই আপনাদের মনে খুব কষ্ট হয়েছে। তার কাজের শাস্তি আপনারা বহন করছেন। সে যদি আপনাদের ভালোবাসে, তবে সে নিশ্চই আর অমন কিছু করবে না। তার পরেও সে যদি তৃতীয়বার একই কাজ করে ,তখন তাকে লাঠির ভাষা শোনান। তবে আশাকরি তার প্রয়োজন হবে না।
আরও পড়ুনঃ শৈশবেই নৃশংসতার পাঠ ! পাঁচ বছরের তাতান বাবার গলায় ধরলো ছুরি
অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানের অন্যায় আচরণে খুব দুঃখ পেয়ে থাকেন। হয়ত বাচ্চা মিথ্যে কথা বলল( এই বয়সে সেটা খুব স্বাভাবিক), বাবা-মা ভাবেন, “ও মিথ্যে কথা বলতে শিখল কী ভাবে? আমরা তো মিথ্যে বলি না। আমার বাচ্চাটা কি তাহলে খারাপ হয়ে গেল?” সবসময় এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বাচ্চারা কল্পনাপ্রবণ হয়। সে ক্ষেত্রে কখনো কোনো সত্যিকে অতিরঞ্জিত করে বলা বা কোনো সময় “এটা তো আমি করিনি”- এরকমটা বলা স্বাভাবিক। এতে তাকে ভয়ঙ্কর শাসন করার কোনও প্রয়োজন নেই। তাকে কাছে ডেকে সে কেন এমনটা করেছে, তার কারণ জেনে নেওয়া দরকার। তারই সাথে তাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, সে যেটা করেছে, ভুল করেছে। এমন করলে সে আপনাদের ভালোবাসা আর পাবে না।
সবসময় লাঠি ব্যবহার করলে যেমন পরে লাঠির গুরুত্ব থাকে না, তেমনি সবসময় বকাবকি বা রাগারাগি করাও ঠিক নয়। তাই বলে আবার সবসময় সব দোষ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে তার খারাপ কাজের গুরুত্ব বোঝালাম না, এমনটাও ঠিক নয়। এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা নেওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, তার বয়স ও তার খারাপ কাজ করার ধরণের ব্যাপারটিও।
এটাও মনে রাখতে হবে ,আপনার উদ্দেশ্য শাস্তি দেওয়া নয়। সে যাতে আর কখনো খারাপ কাজটি না করে, সেটা নিশ্চিত করা।
কীভাবে সন্তানের প্রশংসা করবেন:
সন্তানের প্রশংসা করতে সব বাবা-মা ই ভালোবাসে। সন্তানের সামনে কি তার প্রশংসা করা উচিৎ?তাকে কি বলা উচিৎ সে সবার থেকে ভাল। তার ভুল-ত্রুটি গুলো কি উপেক্ষা করা উচিৎ প্রশংসা করার সময়?
যখন সন্তানের প্রশংসা করবেন, মনে রাখবেন আপনার প্রশংসা যাতে যুক্তিনির্ভর হয়। কারো সাথে তুলনা একেবারে করবেন না। তাকে তার ভালোদিকগুলো আর খারাপ দিকগুলো একইসাথে বলুন। তার সাথে বলুন প্রতিটি মানুষেরই ভালো আর মন্দ দিক থাকে। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই হল মন্দ দিক থেকে ভালো দিকে যাওয়া। আমরা সবাই কিছু কিছু জিনিস খুব ভালো পারি, কিছু জিনিস মোটামুটি পারি, আর কিছু জিনিস একদমই করতে পারি না। তাকে বোঝান ,আমরা কোন দিকে সবচেয়ে বেশি দক্ষ , সেটা খুঁজে বের করে ফেলাই আসল কাজ। অন্যের সঙ্গে তুলনা করে আমরা নিজের শক্তিশালী দিকগুলোকে অবহেলা করে যাই ক্রমাগত। তারপর হতাশায় ভুগতে থাকি। তাকে শৈশব থেকেই শেখান যে, যখন আপনারা তার ভুলগুলোকে ধরিয়ে দেন, সেটা তার নিন্দা নয়, গঠনমূলক প্রশংসা। তাকে বলুন, সে যদি কোনো ভালো কাজ করে, তাহলে কেউ প্রশংসা করুক, বা না করুক, তাতে কিছুই যায় আসে না; কারণ তার ভালো কাজটি নিজেই তার প্রশংসা করছে। এইভাবে আপনার শিশুর ক্ষেত্রে প্রশংসা আর সমালোচনার পার্থক্য কমাতে থাকুন। চেষ্টা করুন , প্রশংসা আর নিন্দার বদলে গঠনমূলক মন্তব্য করার(গাইডেন্স)। সেও যাতে এরকমভাবে ভাবতে শুরু করে, তা দেখুন। দেখবেন সে বড় হলে ,কারো প্রশংসা শোনার অপেক্ষায় থাকবে না। সমালোচনাতেও ভেঙে পড়বে না।এমন মানুষরাই জীবনে বেশি সফল হয়।
নোট খাতায় মায়ের হাতের লেখা:
অনেক বাচ্চারই হাতের লেখা খুব সুন্দর নয়। আপনার সন্তানকে লাইন টানা খাতায় হাতের লেখা অনুশীলন করাতে পারেন। আপনি ডিক্টেশন দেবেন, সে লিখবে; এমনটা করাতে পারেন। কিন্তু কখনোই তার কাজগুলো আপনি নিজে করবেন না। তার ব্যাগ গুছানো থেকে শুরু করে, হোমওয়ার্ক, পেন্সিলবক্স গোছানো থেকে শুরু করে নোট খাতায় প্রশ্নোত্তর লেখা; যত বেশি কাজ সে নিজে নিজে করবে, তত স্বাবলম্বী হবে সে। এসব চেষ্টা করুন ছয় বছর থেকেই। প্রথমে তাকে ডেকে দু-চার দিন তার সামনে করে দেখিয়ে দিন, তাকে বলে দিন অমুক দিন থেকে তুমি নিজেই এসব করবে। সেইমত তাকে করতে দিন, আপনি পাশে থাকুন এক সপ্তাহ, তারপর সে নিজে নিজেই করতে থাকবে।
কখনো কখনো পিতামাতা, বিশেষ করে মা , ভাবেন সন্তান নিজে নিজে কাজ করা শুরু করবে , মানে তার হাত থেকে সন্তানের কর্তৃত্ব চলে যাবে।কিন্তু এটা অযৌক্তিক ভাবনা। আপনার শিশু যত স্বাবলম্বী হবে, আপনার তত সুবিধে। একদিকে আপনি নিজের জন্য সময় বের করতে পারবেন, অন্যদিকে সে তার কাজ নিজে করলে তার মধ্যে দায়িত্ববোধ আসবে, আত্মসম্মানবোধ আসবে। এছাড়াও নিজের কাজ নিজে নিজে করলে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে, চরিত্র দৃঢ় হবে। প্রত্যেক বাবা-মা ই তো চায় তাদের সন্তান এমনই হোক।
আরও পড়ুনঃ সন্তানকে মনের মতো মানুষ করতে হলে এই কয়েকটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখুন
বন্ধু-বান্ধবী ম্যানেজমেন্ট:
আপনার সন্তানের স্কুলে তার বন্ধু-বান্ধবী নিশ্চই তৈরি হবে। মাঝে মাঝে ফোনও আসবে, পড়ার বিষয়ে, তারপর আপনার সন্তান তার বন্ধু-বান্ধবীর সাথে দু-এক কথাও বলবে। তাকে একটু স্বাধীনতা দিন কথা বলার। সে কী কথা বলছে , অব্যশই তার খোঁজ রাখুন। কিন্তু তার সামনে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
আট-নয় বছর বয়স থেকেই আপনার সন্তান কিন্তু ভালোভাবেই বুঝতে পারে, তার অস্তিত্ব তার মা-বাবার অস্তিত্ব থেকে আলাদা, তার পছন্দ-অপছন্দও আলাদা। সে একটি অন্য মানুষ। তারপর তার সামাজিক সত্তা চেষ্টা করে বন্ধু তৈরি করার। কারণ সে নিশ্চই আপনার সাথে সেই কল্পনার কথাগুলো বলে তত মজা পাবে না, বা সেই খেলাটি খেলে তত আনন্দ পাবে না, যা সে তার সমবয়সি বন্ধু বা বান্ধবীর সাথে পাবে। তার উপর আজকাল তো বেশিরভাগ দম্পতির একটিমাত্র সন্তান, ফলে ভাই বোনের অভাবও অনেকটা বন্ধুরা মিটিয়ে দেয়। তার এই সামাজিকতার স্বাভাবিক সত্তাকে অতিরিক্ত শাসনে নষ্ট করবেন না।
তার বদলে আপনিও তার বন্ধুদের সাথে মিশুন, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। আপনার সন্তান কার সাথে মিশছে , সেটা জানা আপনার শুধু অধিকারই নয়, দায়িত্বও বটে।
ছেলে- মেয়ের পার্থক্য:
একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে যে স্বাভাবিক পার্থক্য আছে, সে সম্পর্কে এখনকার ছেলে-মেয়েদের অল্পবয়স থেকেই ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বয়ঃসন্ধির অনেক আগেই তাদের মধ্যে কৌতূহল না হলেও পার্থক্যবোধ এবং তৎসম্বন্ধীও আলোচনা হওয়াও স্বাভাবিক। আপনি চেষ্টা করুন, আপনার সন্তানকে বোঝাতে যে, একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে শুধু শারীরিক গঠনেই পার্থক্য আছে, তাছাড়া তারা সবরকম ভাবেই এক। সে নিজের বাবা- মা কে দিয়ে এর সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। এইভাবে তার মধ্যে অতিরিক্ত কৌতূহলগুলো নিবৃত্ত করুন। তাকে বলুন এ সম্পর্কে তার মধ্যে কোনো প্রশ্ন আসলে সে যাতে তার বন্ধু-বান্ধবীদের জিজ্ঞেস না করে, সরাসরি আপনাকে জিজ্ঞেস করে; কারণ তার বন্ধুরাও তো তার বয়সী, তাদের জ্ঞানও তাদের মতোই সীমাবদ্ধ। আপনিও চেষ্টা করুন তার সব প্রশ্নের যথাসম্ভব যুক্তিপূর্ণভাবে উত্তর দিতে। তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে বা তার যুক্তিতে না বুঝতে পারলে সে কিন্তু অন্যখানে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে।
আরও পড়ুনঃ সন্তানের মনোযোগের অভাব ? কী করবেন আপনি ?
যৌনতা- কৌতূহল:
যৌনতার কৌতূহল মানেই অসভ্যতা নয়। যদি তাই হয়, তাহলে আপনার সন্তান তো আপনাদের চরম অসভ্যতার ফসল। এমন কথা শুধু পাগল আর রামছাগলই বলতে পারে। আমাদের শৈশবের সময়ের থেকে এখন এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সবরকম তথ্যই তো আগে চলে আসে সবার কাছে; তা বাচ্চাদের কাছেও আসে। নর-নারীর সম্পর্ক একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। তাই আপনার সন্তানকে ধাপে ধাপে যৌনশিক্ষা দিন। এটা দুর্ভাগ্য যে আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে এখনো এ ব্যবস্থা কার্যকরী হয়নি। তাই আমাদেরই এ দায়িত্ব নিতে হবে। বাবা অথবা মা অথবা দুজনই এ বিষযে দায়িত্ব নিন।সন্তানের যাতে বিশ্বাস থাকে যে আমার প্রশ্নের উত্তর বাবা বা মায়ের কাছেই আমি পেয়ে যাব, তাহলে দেখবেন সে যৌনতা সম্পর্কিত ব্যাপার নিয়ে অন্যদের কাছে বেশি কৌতূহল দেখাচ্ছে না। কিভাবে ধাপে ধাপে যৌনশিক্ষা দেওয়া যায়, তা নিয়ে ইউটিউবে নিশ্চয় তথ্য পাবেন। গুগলে “sex education for children” সার্চ করতে পারেন। সব বয়সের জন্য কিভাবে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব ,তা নিয়ে পরে একদিন বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ থাকল। মনে রাখবেন, আপনার সন্তানের পরীক্ষার আগে আপনি রাত জেগে কাটান। আর তার সারাজীবনের ভালো থাকার জন্য নিজেই একটু পড়াশুনা করে তাকে যৌনশিক্ষা দেবেন না !! তার স্বাভাবিক যৌনতার থেকে অশ্লীলতার দিকে যাওয়া কিন্তু আপনিই একমাত্র আটকাতে পারেন। অনেকে ভাবেন সন্তানকে যৌনশিক্ষা দিলে সন্তান তাকে আর আগের মত শ্রদ্ধার চোখে দেখবে না। ভুল ধারণা। তার চেয়ে বরং আপনার সন্তান আরো বেশি করে আপনাকে নির্ভর করতে শিখবে, আরো বেশি করে আস্থা তৈরি হবে আপনার শিক্ষা আর বিশ্বাসের উপর।
সন্তানকে ফেল করান মাঝেমধ্যে:
চমকাবেন না। বুঝিয়ে বলছি। ফেল মানে পরীক্ষায় পাশ-ফেল নয়। একটু ভাবুন তো , ছোটবেলায় হাঁটতে গিয়ে সে কতবার পড়েছে? কিন্তু আপনি কি ততবারই তাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। তাহলে কি আপনার সন্তান আজ হাঁটতে পারত? জীবনে ছোটখাট ফেল করা দরকার ।সবকিছুতেই আমি প্রথম হব, যা করব, আমিই সবচেয়ে ভাল করব, এরকম ভাবনা একটি শিশুর প্রথমে আসে না , তার মধ্যে এমন ভাবনা ঢোকানো হয়। তার ফলে সামান্য হোঁচট লাগলেই এরকম মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে, ভেঙে পড়ে।
জীবন অনেক বড়। অনেক মহৎ। দু- চারবার অসফল হলে জীবনের কিছুই এসে যায় না। তাই অসফলতা কে শুধু মাত্র একটা ঘটনা হিসেবে দেখান, যার থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষা নিতে হবে। তাকে মাঝে মাঝে এমন কিছু করতে দিন , যা সে করতে পারবে না। যেমন আপনি একটি ছবি দিয়ে তাকে আঁকতে বলতে পারেন। সে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, তখন তাকে বলুন , যে ওই ছবিটা কার আঁকা? এবং তিনি কত বড় শিল্পী ছিলেন। এতে তার মধ্যে অন্যদের পরিশ্রম সম্পর্কে ধারণা ও শ্রদ্ধা জন্মাবে। তার সাথে খেলে তাকে মাঝে মধ্যে হারিয়ে দিন। সে দৌড় প্রতিযোগিতায় অষ্টম হলেও তার মধ্যে হীনমন্যতা বা প্রথম যে হয়েছে, তার প্রতি হিংসা জন্মাতে দেবেন না। তার চেয়ে আপনি বলুন ,ওরা তার থেকে বেশি পরিশ্রম করেছে, এবং আজ দিনটি ওদের ছিল। সেও পরিশ্রম করলে এবং চেষ্টা করলে একদিন আরো ভালো করতে পারবে। তার জন্য নাকের সামনে গাজর ঝুলিয়ে দেবার মত প্রথম বা দ্বিতীয় হবার লক্ষ্য দেবেন না। আরো ভালো করার উৎসাহ দিন আর বলুন ভালোর কোনো শেষ হয় না। মাননীয় এ.পি.জে. আব্দুল কালাম স্যার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যে বিষয়টি ,সেটি হলো আমাদের জীবনে ব্যর্থতা এলে আমরা তা সামলাবো কিভাবে?
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার:
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তিগত উপকরনগুলো যেমন কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও টিভির বিভিন্ন চ্যানেলগুলো আসলে ভীষণ শক্তিশালী এক একটি মাধ্যম। আর যারা স্পাইডারম্যান সিনেমা দেখেছেন তারা কখনো আঙ্কেল বেন এর মৃত্যুকালীন সেই অমোঘ উক্তি কখনোই নিশ্চই ভোলেননি “ with great power comes great responsibility “ (যত বেশি ক্ষমতা ও শক্তি বাড়বে, দায়িত্বও তত বেশি বাড়বে)। আপনার সন্তানকে তাই ছোটবেলা থেকেই এগুলির দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহার সেখান। এগুলো যে নিছক খেলার জিনিস নয়, তা বারবার পরিষ্কার করুন তাদের কাছে। ভাববেন না স্মার্টফোন ব্যবহার করলেই সে স্মার্ট হয়ে যাবে। ফেসবুক এর সিইও মার্ক জুকেরবার্গ কিন্তু তার সন্তানদের ফোনে হাতই দিতে দেন না। গুগল এর সিইও সুন্দর পিচাই এর বাড়িতে ঢোকার আগে একটি ছোট ঘরে সমস্ত ফোন রেখে দেওয়া হয়। বাচ্চাকে ছয় বছর বয়সে কোডিং শেখানোর , খুব কম বয়সে আ্যপ তৈরি করে ধনী করার বিজ্ঞাপনী মোহের পাশাপাশি এই তথ্যগুলিও আপনার জেনে রাখা ভালো।
আরও পড়ুনঃ ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির পথ, জেনে নিন বিশেষজ্ঞর পরামর্শ
ভালো বাবা- মা:
আদর্শ বাবা- মা তারাই যারা বাচ্চাকে সাহায্য না করে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের সন্তান কিভাবে বারবার হোঁচট খেয়েও আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। তারা ভাবেন তার অসফলতার শিক্ষাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করা যায়? খুব ভালোভাবে বিচার করলে দেখা যাবে সফল মানুষ তারাই যারা নিজেদের ব্যর্থতাকে খুব বাস্তবোচিত ভাবে সামলেছেন আর পরবর্তী কাজের জন্য তৈরি হয়েছেন। বাঙালির চিরকালের স্বপ্ন “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। কিন্তু এখন নেই সেই পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু। তাই মধ্যবিত্ত বাঙালিকেও বদলাতে হবে চিন্তাভাবনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীর বাঙালি আর ভারতচন্দ্র বর্ণিত বাঙালির মধ্যে আজ জমিন-আসমান পার্থক্য।শুধু পোশাক-আশাক, বাহ্যিক জীবনযাপন , খাওয়া-দাওয়ায় কসমোপলিটান হলেই হবে না; চিন্তাভাবনাতেও হতে হবে।প্রত্যেক বাবা- মায়ের ই তাই উচিৎ শিশুকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
যত্নে রাখুন শৈশব:
শৈশব ফেরৎ আসেনা। তাই শৈশবকে তার মত করে বাঁচতে দিন, কল্পনা করতে দিন, মাটি ঘাঁটতে , পুতুল খেলতে, কাগজের নৌকা আর বল বানাতে দিন। সে তার নিজের সৃষ্টিশীলতায় তৈরি করুক তার নিজস্ব জগৎ, যেখানে বড়দের প্রবেশাধিকার মানা।
অমিতাভ দাষ।
Child and adolescent counselor. Child psychotherapist.
Whats app- 7001596757