বেঙ্গল লাইভ Special

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির পথ, জেনে নিন বিশেষজ্ঞর পরামর্শ

বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত (Sushant Singh Rajput)- এর মৃত্যুতে ফেসবুক-টুইটার সহ সমগ্র সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবার ফিরে আসছে একটি শব্দ– ডিপ্রেশন। কিন্তু কী এই ডিপ্রেশন ? কেন হয় ? কীভাবে দূরে থাকা যাবে ডিপ্রেশন থেকে ? তিন কিস্তিতে জেনে নিন ডিপ্রেশনের সাত-সতেরো। লিখছেন আমাদের বিশেষজ্ঞ অমিতাভ দাষ । আজ _প্রথম কিস্তি।

Bengal Live স্পেশালঃ আমি তখন খুব ছোট। বয়স হবে পাঁচ বা ছয়।হঠাৎ জানতে পারলাম আমার মায়ের পিসতুতো ভাই, হারুমামা, সে ফাঁসি দিয়েছে। তাকে আর তারপর কোনোদিন দেখিনি। আমি ছিলাম তার খুব ন্যাওটা। আমি যখন ডিপথিরিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, সেই মামাই জেগে বসেছিল তিন রাত ধরে। আমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে, মাধ্যমিকের আগে এবং পরেও সেই হারুমামার আলমারি ভর্তি সাজানো গল্পের বই পড়েছি।তাদের বাড়ির পেছন দিকে তার আলোছায়া ভরা ঘরটাতে গিয়েছি বহুবার। হারুমামার মা ঘরটা আগের মতোই সাজিয়ে রেখেছিলেন। শুধু দেয়ালে যোগ হয়েছিল মামার একটা সাদাকালো ছবি।

অনেক বছর পর হারুমামার ছোটভাই বুকুনমামাও ফাঁসি দিয়েছিল। স্ত্রী আর তিন বছরের সন্তান রেখে। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আমি শ্মশানে যাইনি। তারপর থেকে তাদের বাড়িতেও যাইনি আর কখনোই।
হারুমামার মৃত্যুর কারণ বোঝা বা জানার বয়স আমার ছিল না। পরে শুনেছিলাম প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে সংবেদনশীল সতেরো বছরের মানুষটা নিজেকে শেষ করেছিল। আর বুকুনমামার নাকি ছিল অনেক পাওনাদার। তাদের পাওনা মেটাতে পারবেন না বলে বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যা। গাছের ডালে ফাঁসি। তার মনে হয়েছিল, এটাই মুক্তির পথ। (নামগুলো পরিবর্তিত। কারণ ঘটনাগুলো সত্যি।)

এর পরেও আমার আত্মহত্যার সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে আরো দু-এক বার। আমার প্রিয় বন্ধুর মেজদা বিয়ের আট মাস পর ঝুলেছিল লিচুগাছের ডালে। ভোরবেলায়।আমার পাড়াতুতো ভাই রাতে ক্লাবে ক্যারাম খেলে রাত দুটোয় বিষ খেয়ে মারা যায় চার বছরের শিশুকন্যা রেখে। কারণ যাই হোক। সবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই — মুক্তি।

অন্যরকম মৃত্যু যত বিস্ময় রেখে যায়, আত্মহত্যা তার চেয়ে দু-একটা বেশি রেখে সবসময়েই চ্যাম্পিয়ন। কারণ প্রতিবেশী, অন্য পাড়ার চায়ের আড্ডায় তার বেঁচে থাকা আরো কিছুদিন। শুধু কাছের মানুষগুলোর চোখের জল শুকিয়ে যাবার পর যে দাগটুকু থাকে, তার জ্বলন পোড়া ছাই এর মত চোখের কোনে আটকে থাকে বহু যুগ ধরে।

সম্প্রতি জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুতে ফেসবুক-টুইটার সহ সমগ্র সোশ্যাল মিডিয়া জগতে যে কথাটি বারবার চোখে পড়ছে তা হল ডিপ্রেশন ও তার ফলে আত্মহত্যা। কিছু বছর আগে আমেরিকার এক জনপ্রিয় পত্রিকা Calgeryherald একটি সমীক্ষায় জানিয়েছিল 2020 ও তৎপরবর্তী দশকে আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যেসব রোগে মৃত্যুর কারণ সবচেয়ে বেশি হতে চলেছে , তার মধ্যে দ্বিতীয় কারণ ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যা। খুব দ্রুত আধুনিক নাগরিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলা ভারতবর্ষও কিন্তু খুব একটা পিছিয়ে নেই। আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আধুনিক ভারতবর্ষেও প্রতি হাজারে প্রায় পঞ্চাশ জন মহিলা ও পুরুষ কোনো না কোনো ডিপ্রেশনের শিকার। (Indian Journal of psychiatry)।

ডিপ্রেশন কী ?

ডিপ্রেশন বা অবসাদ অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই একটি মানসিক রোগ, যা সঠিক চিকিৎসায় সেরে যায়। আমরা যখন জন্মাই, সেই মুহূর্তেই আমাদের সাথেই জন্মায় আমাদের মৃত্যু। এটা শুধুই দার্শনিক কথা নয়। আমাদের প্রতিটি কোষে লুকিয়ে থাকে নিজেকেই খুন করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোষবস্তু লাইসোসোম, যা প্রয়োজন পড়লে কোনো কোষকে ধ্বংস করে দিতে পারে, apoptosis অথবা অটোফাজি প্রক্রিয়াতে। এখন কী সেই প্রয়োজন যেটা ঠিক করে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ মেকানিজম ? আবার আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি করে এমন কিছু অসুখ যাদের অটো ইমিউনরোগ বলা হয়। খুব সাধারণ এলার্জি থেকে শুরু করে হাঁপানি এবং মারাত্মক Anti-phospholipid সিনড্রোম এর মধ্যেই পড়ে।

ডিপ্রেশনের বীজও তেমন বোনা থাকে আমাদের DNA এ তেই। শুধু পূর্ব পুরুষের অবসাদগ্রস্ত হওয়াই একমাত্র কারণ নয়। গর্ভাবস্থায় মায়েদের হরমোনের ওঠাপড়ার কারণে মনখারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তার ওপর শেষ তিন মাসে অস্বাভাবিক শারীরিক গঠনের জন্য শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তিতে ভোগেন প্রায় সব হবু মা-ই । এছাড়াও সন্তানের চিন্তা, স্বাভাবিক জীবন থেকে প্রায় একবছর দূরে থাকা, ভবিষ্যৎ জীবনের ভাবনা- মায়ের এসব চিন্তাই কিন্তু প্রভাবিত করে গর্ভস্থ সন্তানকে। গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান জন্মের অব্যবহিত পরেও মা হতে পারেন ডিপ্রেশনের শিকার।
বহু দিন ধরে চলা গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনে যাওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ। কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক কম। হয়ত প্রকৃতি নারীদের সেভাবেই তৈরি করেছে।

ডিপ্রেশন কোন বয়সে বেশি হয় ?

অদ্ভুতভাবে ডিপ্রেশন হওয়ার কোনো বয়স নেই। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ– যেকোনো মানুষের অবসাদ আসতে পারে। তবে বয়ঃসন্ধির আগে শিশুদের ডিপ্রেশন হওয়ার হার খুব কম, দুই শতাংশ পর্যন্ত। বয়ঃসন্ধিতে যা বেড়ে গিয়ে আট থেকে দশ শতাংশ হয়। বৃদ্ধাবস্থায় অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন প্রায় আট শতাংশ মানুষ।

ডিপ্রেশন মানেই কি আত্মহত্যা ?

একদমই তা নয়। ডিপ্রেশনের চরমতম দিক নিশ্চই আত্মহত্যা। কিন্তু পৃথিবীতে যত রকমের অসুখ রয়েছে, ডিপ্রেশন তার মধ্যে সবচেয়ে সঠিকভাবে সারানো সম্ভব, যদি সেই ব্যক্তি সঠিকভাবে সময়মতো চিকিৎসা করাতে পারেন। তবে অন্যান্য রোগের মতো শুধু ওষুধ-পথ্য দিয়ে এ রোগ সারে না। পরিবার ও নিকটজনের সানিধ‍্য এবং কাউন্সেলিং এর দ্বারা এর চিকিৎসা করা সম্ভব।

কেন হয় ডিপ্রেশন ?

আমাদের মস্তিষ্ক অনেকগুলি ভাগে বিভক্ত। তারা বিভিন্ন কারণে নিঃসরণ করে অনেকগুলি হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার। দেখা গেছে মস্তিষ্কের হিপোকাম্পাস, সিনগুলেট এবং কর্টেক্স অঞ্চলের সামনের দিক বিঘ্নিত হলে এবং কর্টিসল সহ আরো কিছু হরমোনের ক্রমাগত সমস্যার কারণে অবসাদ হয়। প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু থেকে শুরু করে কাজ হারানো, সম্পর্ক নষ্ট হওয়া, সম্মানহানি, পুরোনো কোনো কষ্ট, হঠাৎ মানসিক আঘাত, ক্রমাগত স্ট্রেস, জীবনের বিভিন্ন সমস্যা—দীর্ঘদিন ধরে মানুষ বয়ে চললে একসময় ডিপ্রেশন হতে পারে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ডিপ্রেশন আবার অনেকগুলি শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রতিটি নির্ণয় করার ক্ষেত্রে সময়ের পার্থক্য রয়েছে অর্থাৎ কার কতদিন ধরে মনখারাপ চলছে এবং সেটা ডিপ্রেশন কিনা, তা নির্ভর করছে কেন মনখারাপ, তার ওপর।

সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা অনেক জটিল অসুখের মতো ডিপ্রেশনেও ভীষণ জরুরি। প্রাথমিক ক্ষেত্রে তেমনি জরুরি সঠিক চিকিৎসক নির্বাচন। সাধারণ ডিপ্রেশন এর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার থেরাপিস্টের কাছে গেলে কাজ হয়ে যায়। খুব জটিল ক্ষেত্রে একইসঙ্গে সাইকিয়াট্রিস্ট ও থেরাপিস্ট এর প্রয়োজন পড়ে। সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসা করেন তাৎক্ষণিক শারীরিক সমস্যাগুলি দূর করার। আর থেরাপিস্টের কাজ হয় ডিপ্রেশন এর মূল কারণগুলো বের করে, ব্যক্তিকে ভবিষ্যতের জন্য মানসিকভাবে তৈরি করে দেওয়া।

(চলবে)

Related News

Back to top button