সার্ধশতবর্ষ পার করে চূড়ামণ উচ্চ বিদ্যালয়, জেলার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

Bengal Live পোর্টজিনঃ উত্তর দিনাজপুরের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চূড়ামণ প্রহ্লাদচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। ব্রিটিশ আমলের সেই স্কুলের ইতিহাস তুলে ধরলেন বিশিষ্ট ইতিহাস অন্বেষক বৃন্দাবন ঘোষ।

পূর্বকথনঃ

বাংলার জমিদাররা ভােগ বিলাসীতায়, দান-ধ্যানে , শিক্ষায় , পূজা-পার্বণে, মন্দির প্রতিষ্ঠায় পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করতেন। চূড়ামণের জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রজাদের শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে জমিদারবাড়ীতে ১৮৬৪ সালে চুড়ামণ মিডিল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতকের প্রথম দিকে মহানন্দার বিধ্বংসী বন্যায় জমিদারবাড়ি ভেঙ্গে পড়ে । তখন বর্তমান স্কুল প্রাঙ্গণে ইটের দেয়াল ও টিনের ছাউনি দিয়ে দক্ষিণমুখী দুটি লাল রঙের ঘর তৈরী করা হয়েছিল । তখন কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরীর নামে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছিল কে . সি . ইন্সটিটিউশন । সেখানে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত খুব যত্ন সহকারে পড়ানাে হত ।

ভারতবন্ধু পাট্টাদার , যশােদা নন্দন চট্টোপাধ্যায় , বিভূতি ভূষণ মজুমদার , কামনা নাথ বন্দোপাধ্যায় , বলরাম দত্ত , হরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ দান করতেন । ইটাহার , গুলন্দর , মারনাই , খরবা , চাঁচল প্রভৃতি এলাকায় কোন বিদ্যালয় ছিল না । ফলে ঐসব এলাকা থেকে বহু ছাত্রছাত্রী পড়তে আসত । অশ্বিনী কুমার দাস ষষ্ঠ শ্রেণীর পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করে । সেখানে মেয়েদের জন্যও একটি পৃথক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয় । জমিদাররা এই দুটি স্কুলই পরিচালনা করতেন এবং শিক্ষকের বেতনও দিতেন । দুৰ্গাময়ী রায়চৌধুরী চূড়ামণ থেকে ছেলে ভূপালচন্দ্র রায়চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ভূপালপুরে চলে আসেন । তখন থেকে তারা এই বিদ্যালয় পরিচালনা ও ব্যয়ভার বহনে নিরুৎসাহ বােধ করেন । মেয়েদের স্কুলটিরও পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায় । কিন্তু স্থানীয় কিছু মানুষজন ছেলেদের এই স্কুলে পঠনপাঠন ধরে রাখার জন্য ১৯৫৩ সালে জুনিয়র হাইস্কুল শুরু করেন ।

চূড়ামণ প্রহ্লাদচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়

কে.সি. ইন্সটিটিউশন থেকে পি.সি. হাইস্কুলঃ

১৯৬৪ সালের ৩ রা আগষ্ট এই স্কুল ফোর ক্লাস জুনিয়ার স্কুলের ( মেমাে নং- ২০২৪৮ / জি , ডেটেট ০৩.০৮.৬৪ ) অনুমােদন লাভ করে । স্থানীয় মানুষজনের সাহায্য ও সহযােগিতা নিয়ে হায়ার সেকেণ্ডারী করার জন্য খড়ের ছাউনি দেওয়া কয়েকটি লম্বা ঘর বর্তমান স্কুল প্রাঙ্গণে তৈরী করা হয় । ঐ সময়ে নাকি , আগুনে ঐ ঘরগুলি পুড়ে যায় । ঐ আগুনে স্কুলের প্রয়ােজনীয় বহু মূল্যবান কাগজপত্রও পুড়ে যায় । পুরুষােত্তমপুরের রামজীবন সরকার স্কুলের রিজার্ভ ফান্ডের জন্য দশ হাজার টাকা দান করেন । তাই তাঁকে এই বিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হয় । তাছাড়াও তাঁর বাবা প্রহ্লাদ চন্দ্রের নামে এই স্কুলের নামকরণ ( চুড়ামণ পি . সি . হাই স্কুল ) করা হয় ।

১৯৬৭ সালে এই স্কুল এগার ক্লাস হায়ার সেকেন্ডারীর অনুমােদন ( মেমাে নং- ১৬৩৫৬ জি , ডেটেট ২০.০৬.১৯৬৭ ) লাভ করে । তখন এই বিদ্যালয়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন ছাত্র পড়াশুনা করতাে । দূর দূরান্তের ছাত্ররা হােষ্টেলে থেকে পড়াশুনা করতাে । তপেশ চন্দ্র লাহিড়ী , নান্টু ভট্টাচার্য্য , হাবু সরকার , পূর্ণচন্দ্র দাস , গােবিন্দ লাল বন্দোপাধ্যায় , সুভাষ চন্দ্র চক্রবর্তী , কালু মহম্মদ , আফাজুদ্দিন আহমেদ , সত্যেন্দ্র কুমার রায় , অঞ্জলি ভট্টাচাৰ্য্য প্রমুখ শিক্ষক শিক্ষিকা পাঠদান করতেন । তাঁরা অনেকে বিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন এবং তাতে ছাত্রদের লেখাপড়ার অনেক সুবিধে হত । ১৯৬৯ সালে হায়ার সেকেন্ডারির প্রথম পাঁচজন ছাত্র পরীক্ষা দেয় এবং দুজন পাশ করে । ১৯৭৩ সালে এই বিদ্যালয় কো-এডুকেশনের অনুমােদন ( মেমাে নং- ১৬৭৩ ডেটেট ০৩. ১২.৭৩ ) পায় ।

ছাত্রছাত্রী, শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষকদের চেষ্টায় ধারাবাহিক অগ্রগতিঃ

১৯৭৬ সালে এই বিদ্যালয় থেকে ৬২ জন ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দেয় এবং তার মধ্যে মােট চারজন পাশ করে । মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১৯৭৯ সালে প্রথম গােপাল চন্দ্র গুপ্ত প্রথম বিভাগে এবং ১৯৯৯ সালে হােসনেয়ারা খাতুন প্রথম স্টার মার্কস্ নিয়ে পাশ করে । ২০১২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগে স্নেহা কর্মকার ৪৩৬ নম্বর পেয়ে উত্তর দিনাজপুর জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান এবং ২০১৩ সালে কলা বিভাগে রেজিনা খাতুন ৪১২ নম্বর পেয়ে ইটাহার ব্লকে প্রথম স্থান অধিকার করে । প্রধান শিক্ষক আশিস কুমার মজুমদারের উদ্যোগে এই স্কুল ২০০০ সালে হায়ার সেকেন্ডারী ( মেমাে নং- ডি.এস ( এ ) এসডি ১৫৫৭ রেকগ / ২০০০ , ডেটেড ২০.০৭.২০০০ ) এবং ২০০৬ সালের ১৮ ই আগষ্ট ভােকেশনাল কোর্সের অনুমােদন লাভ করে ।

২০১২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই বিদ্যালয় থেকে কল্যাণ দাস প্রথম স্টার মার্কস্ নিয়ে পাশ করে । বিভিন্ন সময়ে এই বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সম্পাদকের পদে সুশীল কুমার ভট্টাচাৰ্য , যােগেন্দ্র নাথ সাহা , বিষ্ণুপদ দাস , জামাইৎ সরকার , রামজীবন সরকার , অবনীভূষণ দাস , বিভূতিভূষণ দাস , মঙ্গল চন্দ্র দাস , নিবাস ব্যানার্জী , রঘুনন্দন দাস , কার্তিক চন্দ্র দাস , উজ্জ্বল দাস নির্বাচিত হন এবং প্রেসিডেন্টের পদে শুভাশিষ সরকার , যতীন্দ্রনাথ বর্মন মনােনীত হন । বিভিন্ন সময়ে ভারতবন্ধু পাট্টদার , যশােদানন্দন চ্যাট্টার্জী , বিভূতিভূষণ মজুমদার , অনন্তলাল দাশগুপ্ত ও তপেশ চন্দ্র লাহিড়ী প্রধান শিক্ষকের , রাজীব লােচন সরকার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের , আশিস কুমার মজুমদার প্রধান শিক্ষকের এবং তাপস বড়াল ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের পদে আসীন হন।

চূড়ামণ প্রহ্লাদচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়

এঁদের উদ্যোগে এবং সরকারের আর্থিক অনুদানে সাড়ে তিন একর জায়গায় বিদ্যালয়ের দ্বিতল বাড়ীঘর , সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং মূল প্রবেশপথ গড়ে ওঠে । দক্ষিণ দিকে একেবারে স্কুল সংলগ্ন মহানন্দার তীরে ছিল নীলকর সাহেবদের নীলকুঠি । এক সময় সেখানে উৎকৃষ্ট মানের নীল উৎপাদন হত । ইতিহাস প্রসিদ্ধ নদীবক্ষের সবুজ উন্মুক্ত প্রকৃতি ছাত্রছাত্রীদের পাঠগ্রহণে অনাবিল আনন্দ দান করে থাকে । ২০১২-২০১৩ সালে এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৮৫৩ জন । ২০১৯ সালে তার সংখ্যা ১৬০৯ জন এবং ত্রিশ জন স্থায়ী শিক্ষক – শিক্ষিকা , পাঁচ জন পার্শ্ব শিক্ষক – শিক্ষিকা এবং দশ জন আংশিক সময়ের শিক্ষক – শিক্ষিকা পাঠদানের সাথে যুক্ত আছেন । ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ মুসলিম , বারাে ভাগ তপশীলি এবং আট ভাগ সাধারণ সম্প্রদায়ভুক্ত ।

প্রচুর তপশীলি উপজাতির গরীব ঘরের ছেলেমেয়ে এই বিদ্যালয়ের পড়াশুনা করে । চূড়ামণ , বাসুদেবপুর , গৌরীপুর , পুরুষােত্তমপুর , গােপীনাথপুর , দোলি দেউল চক , পাতনােলিয়া , মানাইনগর , চন্দনপুর , নধাপাড়া , রামনগর , রাধানগর , কামারডাঙ্গা , টিটিহা , জামালপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে ছেলেমেয়েরা নীল সাদা রঙের পােষাক পরে বিদ্যালয়ে আসে । স্বাধীনতা সংগ্রামী বামাপদ আচাৰ্য্য এবং পণ্ডিত সীতানাথ আচাৰ্যও এই বিদ্যালয় থেকে পাঠগ্রহণ করেন । ২০০১ সালে বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিনয়কুমার মল্লিকের সম্পাদনায় মহানন্দা নামে একটি দেওয়াল পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে । কিন্তু তিনটি সংখ্যা প্রকাশ হবার পর তা বন্ধ হয়ে যায় । এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জেলাস্তরের আবৃত্তি , প্রবন্ধ , বিতর্ক , সঙ্গীত প্রভৃতি প্রতিযােগিতায় যােগ দিয়ে থাকে । তারা পাঁচ ছয় বছর ধরে ২৬ শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে রায়গঞ্জ স্টেডিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করে।

বিদ্যালয়ের ছাত্রী পারমিতা দাস নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির রাজ্যস্তরের আবৃত্তি প্রতিযােগিতা যােগ দিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করে । বিদ্যালয়ের অনতিদূরে চূড়ামণ জমিদারবাড়ীর সামনে রয়েছে তিন একর জায়গা জুড়ে বিদ্যালয়ের নিজস্ব খেলার মাঠ । জমিদারী আমলে জমিদারদের উদ্যোগে এই মাঠে ফুটবল প্রতিযােগিতার আসর বসতাে । আর সেই প্রতিযােগিতায় প্রতি বছর চূড়ামণ গুলন্দরের মুখােমুখি হত । বিশেষ করে তাদের এই দুই দলের খেলা দেখার জন্য এই এলাকার বহু মানুষের সমাগম হত । প্রধান শিক্ষক তপেশচন্দ্র লাহিড়ী খুব ভালাে ফুটবল খেলতেন । বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেখানে তিনি ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করতেন । প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার মজুমদার ও সহ শিক্ষক রমেন্দু দেব সরকার বানবোল হাইস্কুলের ক্যারাম প্রতিযােগিতায় যােগ দিয়ে ব্লক চ্যাম্পিয়ানের শিরােপা লাভ করেন।

চূড়ামণ প্রহ্লাদচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়

২০১৫ সালে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের সার্ধশতবর্ষ উৎসব পালিত হয় । এই উৎসব শুরু করার ব্যাপারে উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদের শিশু ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মসূচীর জেলা সমন্বয়ক ক্ষিতীশ সরকার এবং এই প্রতিবেদক ড . বৃন্দাবন ঘােষও সহযােগিতা করেন । এই বিদ্যালয় উত্তর দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে পুরনাে প্রতিষ্ঠান । বহু ব্রিটিশ পরিদর্শক এই স্কুল পরিদর্শন করেন । দেড়শাে বছরের নানান স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা এই বিদ্যালয়ের সাথে জড়িয়ে আছে , যা আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার সহায়ক । সেদিক থেকে এই উচ্চ বিদ্যালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম । তাই ড . ঘােষ এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়কে হেরিটেজের স্বীকৃতি দানের জন্য আবেদন জানান।

(তথ্যসূত্রঃ- চূড়ামণ জমিদারবাড়ী ও স্বামীনাথ মেলা , বৃন্দাবন ঘােষ , ১৪০৯ বঙ্গাব্দ ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ- তপেশ চন্দ্র লাহিড়ী , আশিস কুমার মজুমদার , তাপস বড়াল , বিনয় কুমার মল্লিক , প্রবােধ চন্দ্র দাস , মঙ্গল দাস , চুড়ামণ উচ্চ বিদ্যালয়।)

— ডঃ বৃন্দাবন ঘােষ

Exit mobile version