ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে কী করবেন ? জানুন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। তৃতীয় কিস্তি।
কোনো ব্যক্তিকে খুব কাছের মানুষরা ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সেই ব্যক্তির অবসাদ হয়েছে বা হতে চলেছে কি না, তা কিছু লক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারবেন। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে কী করবেন ? তৃতীয় কিস্তি। লিখেছেন অমিতাভ দাষ।
ডিপ্রেশনের চিকিৎসাঃ
যে কোনো বয়সেই হতে পারে ডিপ্রেশন। অন্যান্য বেশিরভাগ অসুখে অনেক ক্ষেত্রেই খুব সুস্পষ্ট শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ থেকে আমরা রোগ নির্ণয় করতে পারি। ভালো চিকিৎসা হলে অনেক ক্ষেত্রে রোগের কারণও নির্ণয় করা যায়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে রোগ আর রোগের কারণ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এক হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যদি কারো মাথাব্যথা করে, আমরা সাধারণত OTC (over the counter) ওষুধ খাই, যেগুলি মাথা ব্যাথা সারায়। কিন্তু কী কারণে এই মাথা ব্যাথা হয়েছিল, সেটা জানার চেষ্টা খুব কম মানুষই করে। আবার বুক ব্যথা করলে আমরা কিন্তু তখন ব্যথার ওষুধ খাই না। ডাক্তারবাবুর প্রস্তাবিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, সেটা ফুসফুসের সমস্যা, নাকি ব্লকেজ, না গ্যাসের সমস্যা। সেটা বুঝে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো অনেক জটিল অসুখেও আমাদের চিকিৎসা শুধু লক্ষণের (সিম্পটম) উপরেই হয়।
মহামান্য ডাক্তারবাবুদের অত সময়ও থাকে না, কারণ খোঁজার। এটা নিশ্চই আমাদের তথাকথিত মডার্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকীর্ণতা। তার ওপর এলোপ্যাথি অন্যান্য সব রকম চিকিৎসাকে অবহেলা করে বরাবরই। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি, অনেক ডাক্তারই আছেন, যাঁদের আঙুলভরা লাল, নীল পাথরের আংটি। কিন্তু আয়ুর্বেদ এ যে শরীরের সাম্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়, বা হোমিওপ্যাথিতে যে মলিকুল লেভেলে চিকিৎসার কথা বলা হয়,অথবা কখনো প্লেসিবো চিকিৎসাও কাজে লাগে, সে সম্বন্ধে তারা জানারও প্রয়োজন বোধ করেন না। এটা কখনোই মনে করা হয় না যে, একজন ডাক্তারের কাছে রোগী সুস্থ হওয়াই মূল কথা, সে যে কোনো প্যাথি দিয়েই হোক না কেন। কিন্তু অর্থ বড় দায়। ফলে অনেক ডাক্তারবাবুই বহু ক্ষেত্রে ডাক্তারির শপথ ভুলে ওষুধ কোম্পানিদের লুকানো এজেন্টে পরিণত হয়েছেন।
ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে কিন্তু লক্ষণগুলোর আর কারণগুলোর চিকিৎসা একসঙ্গে করা হয়, নাহলে চিকিৎসা কার্যকরী হয় না। তাই antidepressant ওষুধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে ডিপ্রেশনের কারণ এবং ডিপ্রেশনের জন্য যে ব্যবহারিক প্যাটার্নগুলি (অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলিই মূল লক্ষণ) সমস্যার কারণ হচ্ছে সেগুলিকে বদলানোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ, তাই নিয়মিত কাউন্সেলিং করা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়ে। ওষুধ, কাউন্সেলিং এবং থেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের এবং ব্যবহারিক পরিবর্তনগুলি শোধরানো হয়।এভাবেই আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি অবসাদ মুক্ত হয় ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
প্রথম কিস্তিঃ ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির পথ, জেনে নিন বিশেষজ্ঞর পরামর্শ
ডিপ্রেশনের লক্ষণঃ
কোনো ব্যক্তিকে খুব কাছের মানুষরা ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সেই ব্যক্তির অবসাদ হয়েছে বা হতে চলেছে কি না, তা কিছু লক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারবেন।
১) পরিবর্তিত আচরণঃ
যদি তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের ব্যাপক পরিবর্তন হয়, যেমন অন্যদের সাথে আচরণের হঠাৎ বদল, একা একা থাকতে চাওয়া, বেশি ভাবা, অন্য মনস্ক থাকা, খুব দরকারি কাজগুলোতে আগ্রহ না দেখানো, এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর না দিতে পারা ও কারণ জানাতে বিরক্তি প্রকাশ করা ইত্যাদি।
২) ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তনঃ
ঘুম সাংঘাতিক রকমের কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া। অনেকদিন ধরে গভীর ঘুম না হওয়া। বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়া।
৩) খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনঃ
খাওয়া অস্বাভাবিক কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া। প্রিয় খাবারগুলিতে অনেকদিন ধরে কারণ ছাড়াই অনিহা প্রকাশ করা।
৪) আবেগের নিয়ন্ত্রণহীনতাঃ
ব্যক্তির দুঃখপ্রকাশ বা আনন্দপ্রকাশ এর আচরণের পরিবর্তন বা বৃদ্ধি পাওয়া। হঠাৎ কাঁদা বা হঠাৎ হাসতে থাকা, যেন কিছু মনে পড়েছে, ভয় বা একাকিত্বের অনুভূতি বেড়ে যাওয়া।
৫) ঋণাত্মক চিন্তাঃ
নেগেটিভ চিন্তাভাবনা বেড়ে যাওয়া, সবকিছুতে খারাপ যুক্তি খোঁজার প্রবণতা। কোনো কিছুতেই ভালো খুঁজে না পাওয়া। নিজের সম্পর্কে বারবার হতাশা ব্যক্ত করা। তাকে কেউ পছন্দ করে না, সে দলছুট এক ব্যক্তি, এমনটা বলা। মৃত্যুচিন্তা করা, মৃত্যুই একমাত্র মুক্তির পথ, এরকম করে ভাবা ও বলা, তবে সেটা সরাসরি নাও হতে পারে।
৬) গোপনীয়তাঃ
ব্যক্তির জীবনে গোপনীয়তা বা secretive behaviour বেড়ে যাওয়া।সে যেন সবসময় কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। তার কাছে গেলে চোখের মণি চঞ্চল হয়ে উঠছে, যেন সে মনে মনেই অন্য ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছেন।
৭) স্বাভাবিক ও পেশাগত
জীবনে অবহেলাঃ
অবসাদের ফলে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ব্যাহত হয়। সে দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, পেশার ক্ষেত্রে অবহেলা দেখাতে থাকে। কোনো নির্দিষ্ট কাজে বেশিক্ষণ মন বসাতে পারে না।
৮) নেশাবৃদ্ধিঃ
কখনো কখনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে অনেকসময় প্রাথমিকভাবে মনের সমস্যা মেটানোর জন্য নেশাই একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নেশা করলে সাময়িকভাবে ব্যক্তির ভালো লাগলেও বেশিদিন এমন চলতে থাকলে তা ভয়ঙ্কর সমস্যায় পরিণত হয়। যদি এক থেকে আট এর উপরিউক্ত সমস্যাগুলি নেশা করার কারণে হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে নেশার চিকিৎসা আগে করানো উচিৎ। সেক্ষত্রে বুঝতে হবে, শুধুই নেশা করার কারণে ঐসব সমস্যা হয়েছে, না কি অবসাদ হয়েছে,তারপর ওই ব্যক্তি নেশা শুরু করেছেন । কারণ অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষণগুলি প্রাথমিকভাবে একই রকম। ব্যক্তির নিকটজনকে তাই নেশার ব্যাপারে এবং কী রকম নেশা করে ( অ্যলকোহল, ব্রাউন সুগার ইত্যাদি) , সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হতে হবে।
৯) ব্যথার অনুভূতিঃ
অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি শরীরে বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভব করেন, সেটা মাথাব্যথাও হতে পারে। যদিও সেসব ব্যথার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলিকে সোমাটিক সিম্পটম বলা হয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি সত্যিই ব্যথা অনুভব করেন।
ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলি দুই সপ্তাহ বা তার বেশিদিন ধরে চলতে থাকলে, সাবধান হয়ে যাওয়া উচিৎ এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সেলর এর পরামর্শে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা হবে, তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবার সম্ভাবনাও থাকবে। খুব কম দিন ধরে চলতে থাকা ডিপ্রেশন খুব সামান্য ওষুধ ও সামান্য কয়েকদিনের থেরাপিতেই সেরে যায়।
আবার এমনও হতে পারে, যে কোনো ব্যক্তি দুই বা তিন সপ্তাহ পর ডাক্তার বা থেরাপিস্টের সাহায্য ছাড়াই ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু যদি এরকম লক্ষণ দ্বিতীয়বার ঘুরে আসে, তখন অবশ্যই বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিৎ। মনে রাখতে হবে পরিবারে একে অন্যের সাথে যত বেশি খোলামেলা সম্পর্ক, আলোচনা হবে, তত বেশি ডিপ্রেশনের থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
দ্বিতীয় কিস্তিঃ ডিপ্রেশন কাদের হয়, কখন হয়? জেনে নিন বিশেষজ্ঞর লেখায়
অবসাদ হলে কি করবেনঃ
উপরের লক্ষণগুলি মিলে গেলে সবার প্রথমে সবচেয়ে কাছের কাউকে লক্ষণগুলি বলুন। কে কী বলবে? কে কী ভাববে? এসব অবাস্তবিক চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। ডিপ্রেশন অন্য রোগগুলোর মতোই একটি রোগ মাত্র। যে আপনাকে বোঝে, সে সবসময় আপনার পাশে থাকবে। তাই তার সাথে বিশেষজ্ঞের কাছে যান যত তাড়াতাড়ি পারেন। ওষুধ খাবার সাথে সাথে থেরাপিস্টের কাছেও নিয়মিত যান। তার প্রস্তাব মত জীবনযাপন শুরু করুন। বেশি দেরি করলে আপনার মানসিক অবস্থা এমনও হয়ে যেতে পারে যে, আপনি চিকিৎসার ওপরেও ভরসা করছেন না। সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ, যে কোনো রোগের ক্ষেত্রেই।
মনে রাখবেন। যারা আত্মহত্যা করে, তারা এমন মানসিক অবস্থায় থাকে যে, ভাবতে শুরু করে জীবন-যন্ত্রণা থেকে যেভাবেই হোক , এই মুহূর্তেই মুক্তি পেতে হবে। তারা আসলে মরতে চান না, যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি চান। তারা ভুলেই যান যে একদিন তো মরে যেতেই হবে, না চাইলেও।
আত্মহত্যায় শুধু সেই ব্যক্তিরই মৃত্যু হয় না, মৃত্যু হয় বিশ্বাসের, সেই ব্যক্তি ভুলেই যান তার শরীর হয়তো মরে যাবে, কিন্তু তিনি মুক্তি পাবেন কি? তার প্রিয়জনদের চোখের জল আর খারাপ-স্মৃতির জেলখানায় তাদের আটকে থাকতে হবে অনন্তকাল। মৃত্যু নিয়ে যে প্রশ্নচিহ্ন সে দিয়ে গেল, তার প্রিয়জনেরা সেটা বয়ে বেড়াবেন আজীবন।
আজও যখন হারুমামার কথা মনে পড়ে, স্মৃতিতে উঁকি দেয়, একটা পুকুরের পাশে একটা বেড়ার ঘর।খোলা জানালা। আমাকে হারুমামা নিয়ে গেছে সেই বাড়িতে সাইকেল করে। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে এক নারী গল্প করছে আমার সাথে। আমি হারুমামার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছি । অথবা আমার পাড়ার মৃন্ময়, যার সাথে দিনে একবার হলেও দেখা হত। তার বাবাকে যখন দেখি। মাতাল হয়ে বড় রাস্তার ধারে গাছতলায় শূন্য চোখে বসে আছে। তখন মনে হয় ,আমরা না চাইলেও যে শূন্য স্মৃতির দায়ভার বহন করছি অনন্তকাল, তার উৎস হয়তো ছিল শুধুই একটু মনখারাপ। তাও এমন একজনের , যে জানতই না যে, তার মনখারাপ অসুখ হয়ে ঘুণপোকার মত কুড়ে কুড়ে খাবে অনেক দূরের অন্য কারোর অস্তিত্ব।