রায়গঞ্জে আসছেন নোবেলের সমতুল্য কিয়টো পুরস্কারে সম্মানিত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, জেনে নিন তাঁর পরিচয়
Nblive শান্তনু মিশ্রঃ
আগামী ৬ এপ্রিল, ২০১৮, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে “উত্তর উপনিবেশবাদ এবং সাবঅল্টার্ন’’ প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখবেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। কিন্তু কে এই স্পিভাক? আসুন, জেনে নিই তাঁকে।
‘আমরা দুজনে মিলে’ কবিতায় বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন “তুমি আর হিন্দু নেই , খৃষ্টান হয়েছো/ তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি/ আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন/ তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা/ ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই”
সম্ভবত বিনয় মজুমদারই একমাত্র কবি যার একটি কাব্যগ্রন্থ কিঞ্চিৎ সংযোজন-বিয়োজনের বিনিময়ে তিনটি সংস্করণে তিনটি ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম সংস্করণে নাম ছিল ‘গায়ত্রীকে’, দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ফিরে এসো চাকা’ আর তৃতীয়তে ‘আমার ঈশ্বরীকে’। আর এই গায়ত্রী চাকা কিংবা ঈশ্বরীই- একাধারে লেখক তাত্ত্বিক চিন্তক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক।
বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক টেরি ইগলটন যার সম্পর্কে মনে করেন “তিনি দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যাচর্চার আন্তর্জাতিক জগতে নারীবাদ ও উত্তর-ঔপনিবেশিকতা চর্চার পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর সহকর্মী তাত্ত্বিকদের থেকে অনেক বেশি সদর্থক রাজনৈতিক কাজ করেছেন।”
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বিদ্যায়তনিক দুনিয়ার বিখ্যাত নক্ষত্র। বিস্তৃত পরিসর জুড়ে তার কাজ। উত্তর-উপনিবেশি ও দেরিদিয় তাত্ত্বিক ঘেরাটোপের অন্যতম প্রধান চিন্তক তিনি। দেরিদার “অব গ্রামাটোলজি” অনুবাদ করে দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি নির্মাণ করেছেন স্পিভাক।
১৯৪২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশশাসিত ভারতের কলকাতায় চিকিৎসক ডাঃ পরেশ চন্দ্র এবং শিবানী চক্রবর্তীর কন্যা হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন গায়ত্রী চক্রবর্তী। ১৯৫৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া। সেখানে তিনি ইংরেজিতে এমএ এবং তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি করেন। ১৯৬০ সালে জনৈক ট্যালবট স্পিভাকের সঙ্গে তিনি সীমিত সময়ের জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে উত্তর উপনিবেশবাদের সূচনাকারী লেখা “Can the Subaltern Speak?” এবং জাক দেরিদার “De la grammatologie” বইটিকে মূল ফরাসি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করা, যেটির ইংরেজি নাম “Of Grammatology”; তিনি তাঁর একটি নিবন্ধে এর বাংলা নামকরণ করেছেন “লিপিতত্ত্বপ্রসঙ্গ”। স্পিভাক নিজেকে মার্ক্সীয়-নারীবাদী অবিনির্মাণিক হিসেবে পরিচিত করেন।
এন্টনিও গ্রামসির চালু করা শব্দ সাবঅল্টার্ন। গ্রামসির মতে, সাবঅল্টার্ন শব্দটি মূলত ব্যবহার করা হয় তাদের ক্ষেত্রে যারা কোনো প্রকার হুকুম দেয় না, বরং তারা কেবল তাদের উপর জারি করা হুকুমগুলো মাথা পেতে গ্রহণ করে।
গায়ত্রী চক্রবর্তী মনে করেন, সাবঅল্টার্ন বলতে বোঝায় ঐ সকল নাগরিককে যাদের নাগরিকত্বের সকল দাবি-অধিকারের কাঠামোয় প্রবেশ করবার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, “আমি ভারতের কথাই ধরতে পারি, সেখানে গাঁয়ের জমিহীন কৃষক আছে যারা ভোটও দিতে পারে কিন্তু নাগরিকত্ব ফলানোর সেই ফ্রেমে তাদের জায়গা হয়না। এরা সবাই সাবঅল্টার্ন।”
সাবঅল্টার্নকে নিজের মতো করে বুঝতে পেরে তিনি ভারতের বিভিন্ন সাবঅল্টার্ন শ্রেণিতে নিজেকে যুক্ত করেন, বর্তমানে যেখানে তাঁর স্কুলগুলি। তিনি মনে করেন, “লোকগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করবার অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে হাজার বছর ধরে, আর তা অস্বীকার করেছে আমার পূর্বপুরুষ জাত হিন্দুরা।”
গায়ত্রীর মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষার মধ্যেকার গলদগুলি স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় থেকে গেছে। ফলস্বরূপ বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিতদের দুটি শ্রেণি স্পষ্ট হয়েছে যথেষ্টই। যার বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে টেকনোক্র্যাট। আর অন্য অংশে— ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যুরোক্র্যাট’। এবং এই দুই শ্রেণির কারোরই সামাজিক ন্যায়বিন্যাস বোঝার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ব্যক্তিগত সাফল্য। আর তাই এদের বোধের আয়নায় জন্ম নেওয়া ‘বোধহীন জাতীয়তাবাদ’ আসলে দেশের উন্নয়ন নয়, বরং অবনয়ন। ব্যক্তিগত লাভের দিকে একমাত্র মনোনিবেশ থাকার ফলে তৈরি হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক লাভের প্রতি উদাসীনতা। গায়ত্রীর ভাষায়, ‘সাস্টেনেবল আন্ডারডেভেলপমেন্ট’।
ঔপনিবেশিক ধারণার প্রতি চূড়ান্ত আস্থা রেখেই ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্য ইত্যাদি যে ভাবে এলিট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হচ্ছে তাতে দেশের মধ্যে কিছু এলিট মানুষের বৃত্ত তৈরি হওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। পশ্চাৎপদ শ্রেণির কিছু ব্যতিক্রমী এই এলিট বৃত্তে জায়গা করে নিয়েছে! ব্যস, এটুকুই। তারাও আসলে সেই এলিট-এরই অংশ।
গ্রামেগঞ্জে স্কুলকলেজ তৈরি হলেও শ্রেণিবিন্যাসে যারা পশ্চাৎপদ, তাদের ভাবনার স্তর আর এলিটের ভাবনাবাক্সের মধ্যে আজও সংযোগ নেই। অথচ তারাই আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ‘গণ’। গায়ত্রী মনে করেন, আজকের ভারতে এই কথাটা আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে বোঝা দরকার।
অথচ বিশ্বের সেরা বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকতে থাকতেও গায়ত্রী নিজে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের বসিয়ে পড়ান। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রতি বছর বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানার নাম-না-জানা গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত করেন। শহরমুখী প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের পরিবর্তে শিশু মন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কী ধরণের পাঠ্যক্রম হওয়া উচিৎ, তা নিয়েও তিনি বিশেষ পরামর্শ দেন পশ্চিমবঙ্গ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন পর্ষদককে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্য ‘আমার বই’, তাঁর সেই পরামর্শেরই ফলাফল।
অর্থাৎ, একদিকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক অধ্যাপনা জগতের একজন বেশ আলোচিত নাম। আবার অন্যদিকে কয়েক দশক ধরে ভারতে অজপাড়াগাঁকে শিক্ষিত করবার কাজও তিনি করছেন।
আপাতদৃষ্টিতে ক্রিটিকাল তত্ত্বের বিশ্ব এবং শিশুশিক্ষা… এই দুইয়ের মধ্যে একটি অনবদ্য ব্যালান্স গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক।
একনজরে দেখে নিই তাঁর জরুরি কিছু কাজ
• Myself Must I Remake: The Life and Poetry of W.B. Yeats (1974).
• Of Grammatology (translation, with a critical introduction, of Derrida’s text) (1976)
• In Other Worlds: Essays in Cultural Politics (1987).
• Spivak, Gayatri Chakravorty (1988). Can the subaltern speak?. Basingstoke: Macmillan.
• Selected Subaltern Studies (edited with Ranajit Guha) (1988)
• The Post-Colonial Critic – Interviews, Strategies, Dialogues (1990)
• Outside in the Teaching Machine (1993).
• The Spivak Reader (1995).
• A Critique of Postcolonial Reason: Toward a History of the Vanishing Present (1999).
• Death of a Discipline (2003).
• Other Asias (2008).
• An Aesthetic Education in the Era of Globalization (2012).
• Readings (2014).
এছাড়াও
• Imaginary Maps (translation with critical introduction of three stories by Mahasweta Devi) (1994)
• Breast Stories (translation with critical introduction of three stories by Mahasweta Devi) (1997)
• Old Women (translation with critical introduction of two stories by Mahasweta Devi) (1999)
• Song for Kali: A Cycle (translation with introduction of story by Ramproshad Sen) (2000)
• Chotti Munda and His Arrow (translation with critical introduction of the novel by Mahasweta Devi) (2002)
• Red Thread (forthcoming)
অনুবাদের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য কিয়টো পেয়েছেন ২০১২। ২০১৩-তে পদ্মভূষণ। আমেরিকার মডার্ন ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যাসোসিয়েশন ২০১৮ সালে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে সম্মানিত করছে “লাইফটাইম স্কলারলি অ্যাচিভমেন্ট” সম্মানে।