Nblive পোর্টজিনঃ সকাল সাড়ে দশটা। রোদঝলমলে রায়গঞ্জ। ফোন কল। হ্যালো… কথা হল অনেকক্ষণ। আয়নার মত স্বচ্ছ… মৃদু… ঘড়িতে একঘন্টা। বাস্তবে কয়েকটা যুগ।
এনবি লাইভের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন শান্তনু মিশ্র
ছবি, লেখা, চিকিৎসা, অভিনয় এই চতুষ্কোণের বাইরে একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
An explorer of different aspect of humanity । আমার স্কুলের শিক্ষাটা যেখানে হয়েছিল, মানে ডন বস্কো… যারা পড়াতেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আইরিশ ক্যাথলিক, রোমান ক্যাথলিক। ঠিক যেমন নরেন্দ্রপুরে আলাদা একটা কালচার আছে, আমাদেরও একটা ছিল। ছোটবেলা থেকে তাঁরা মাথায় একটা কথা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য পয়সা রোজগার অথবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়। বরং মানুষের বিভিন্ন দিকগুলিকে এক্সপ্লোর করা… অর্থনৈতিক, সামাজিক ,ধর্মীয় বেড়াগুলো ভেঙে বিভিন্ন মানুষের সাথে সাথে মেশা। প্রথম থেকেই বলা হত, তুমি যদি ভালো ছাত্রও হও তাহলেও তোমাকে খেলাধুলো, ডিবেট সহ ইত্যাদি চর্চা করতে হবে। এবার চর্চা করতে করতে এক একজনের এক এক রকমের দিকগুলোকে ওনারা অনুপ্রাণিত করতেন। বারো বছর ধরে একটা স্কুল… এই কালচার… বড় হয়ে ওঠার মধ্যে একটা এফেক্ট তো পড়বেই। তাছাড়া বাবা-মা এস.এফ.আই. এক্টিভিস্ট ছিলেন। তাই বাড়িতেও সঙ্গীত, গান, কবিতা ইত্যাদি চর্চা নিয়মিত হত। শঙ্খ ঘোষ, শোমিক বন্দ্যোপাধ্যায় আসতেন। তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই সবটা মিলেমিশেই আমার জীবন দর্শন।
বাড়িতে একটা রাজনৈতিক আবহ আপনার জীবন দর্শন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে বললেন… আপনার রাজনৈতিক দর্শন কী?
নিউট্রাল।
রাজনীতি এবং নিউট্রাল… মানে, ডিটেইলসটা যদি বলেন…
মেডিক্যাল কলেজে ঢুকেছি ১৯৮৩ সাল। আশির দশকে এস.এফ.আই. ছিল, ছাত্র পরিষদও। আমরা ঠিক করেছিলাম একটা নিউট্রাল ইউনিয়ন গঠন করব। নিউট্রাল বলতে যে তাঁদের কোন রাজনৈতিক আদর্শ , মতাদর্শ নেই ঠিক তা নয়। আমাদের মনে হয়েছিল কলেজের গন্ডির মধ্যে সব মতামতগুলিকে সংগঠিত করাটা প্রয়োজন। আসলে, ধর্মঘট, প্রিন্সিপাল ঘেরাও সহ বিভিন্ন কর্মসূচী আমাদের খুব ভালো লাগেনি। অবশ্যই সেই সময়ের প্রেক্ষিতে। তো যাই হোক, পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচ বছরই আমাদের নিউট্রাল ইউনিয়ন জিতেছিল। ছোট বেলা থেকেই বাড়িতে বাম মতাদর্শ ছিল। আদর্শগত দিক থেকে অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সেখান থেকে আমার মনে হয়েছিল সোশালিজম ব্যাপারটা ভালো। সংবেদনশীলতা জিনিসটা ভালো। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শ কাওয়ার্ডনেশের রূপ নিচ্ছে সেটা খারাপ। কলেজে আমাদের সিনিয়ররা, এস.এফ.আই.-এর বন্ধুরা প্রিন্সিপালের সাথে যেই ভাষায় কথা বলছেন সেটা আমাদের খারাপ লেগেছিল। যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকাটাই বাঞ্চনীয়।
পোলারাইজড পলিটিক্সের দিকে আমি কখনও আকর্ষিত হইনি। আমার মনে হয় নাগরিক হিসেবে , বহু বছর আগে অম্লান দত্ত একটি কথা বলেছিলেন। “ A man who is not a part of a political party should have a political thought as a citizen. And the citizens idea should change time to time according to the circumstance .” কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। মানে আজকে আমি একটা মতাদর্শে বিশ্বাস রাখছি বলে, আমার মতাদর্শের আরেকটি লোক যখন অন্যায় করছে, তারও প্রতিবাদ জরুরি বলেই মনে করি। নাহলে, আমি মানুষ হিসেবে প্রপার নাগরিক নই। তবে হ্যাঁ যারা রাজনীতি করছেন তাঁদের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। সেটা তাঁদের নিজস্ব মতাদর্শ। কিন্তু আমার মনে হয় পলিটিকাল আইডিওলজিটা যে কোনো নাগরিকেরই থাকা উচিৎ। ইস্যু ভিত্তিক আমার মতাদর্শ থাকবে। সিঙ্গুর নিয়ে আমার মত থাকবে, আজকের জনমত নিয়ে একটা মত থাকবে, এবং সেটা না হলে গণতন্ত্র কিন্তু থাকেনা। গণতন্ত্র মানেই, the govt should be accountable to the people, and the people should be able to raise question. এটা আমার মধ্যে ছিল, আছে, থাকবে। সুতরাং আমার মধ্যে প্রশ্ন থাকবে। এবং তা আমি প্রশ্ন আকারেই উচ্চারণ করবো।
অভিনয়, ছবি, কবিতা, চিকিৎসা এগুলির মধ্যে পুরনো বন্ধু কে?
সবচেয়ে পুরনো বন্ধুকে খুব একটা মানুষ জানেনা। পাবলিক স্পিকিং। আমাকে ক্লাস এইট থেকে ডিবেটিং ক্লাসে ঢোকানো হয়েছিল। তারপর কলেজ জীবনে ক্যালকাটা ডিবেটিং সোসাইটি আমরা ফর্ম করি ।এখন ক্ষোভ হচ্ছে। কারণ কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষাটা একটা রাজনৈতিক মতের জন্য বহু বছর ছিল না, সেই কারণে ইংরেজি পাবলিক স্পিকিংটা প্রায় অবলুপ্ত। ফলে বাঙালী যুবসমাজ সর্বভারতীয় চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পড়ছেন, উচ্চ শিক্ষায় অসুবিধা হচ্ছে। যাই হোক, এটা আমার প্রথম নেশা এবং এই প্রথম কিংবা পুরনো বন্ধুর হাত ধরেই নাটকে আসা। যদিও পুরোটাই আমার ইংরেজি থিয়েটারের অভিজ্ঞতা। এমনকি কলেজ লাইফেও। আমার বাংলা নাটক অথবা চলচ্চিত্রে অভিনয়টা খুব বেশি বয়সে। ২০০৫ সালে অঞ্জন দত্তের “অবেলায় নিলিমায়” টেলিফিল্মে আমার প্রথম বাংলা অভিনয়। এখনও যদি আমাকে বলা হয় একটা ভালো বিতর্ক সভা আছে, আমাকে বক্তৃতা দিতে হবে। আবার পাশাপাশি যদি বলা হয় বিতর্কে অংশগ্রহণ না করে বন্ধু কমলেশ্বর মুখার্জীর কোনো ছবিতে অভিনয় করতে হবে। তাহলে কিন্তু আমি বিতর্ক সভাটাকেই গুরুত্ব দেব। ১০০ টার মধ্যে এক দুটি ছবি সমাজ, মানুষের মধ্যে চিন্তার একটা নতুন ধারা নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু একটা বিতর্ক সভায় ৫০টা লোক শুনলেও আমি আমার কথার মাধ্যমে কিছুটা হলেও নতুন চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে পারি। কথার জেরেই পৃথিবীর উন্নয়ন হয়েছে। আমার প্রথম প্রেম কথা বলা।
পেশায় আপনি অর্থপেডিক সার্জেন।এবং ছবি, অভিনয়, কবিতা ইত্যাদি… এতগুলো দিক সামলান কী করে ?
এখনকার সাথে আমাদের সময়কার পড়াশুনা, চিকিৎসাপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। কলেজ থেকে পাশ করে বেরনোর পর প্রায় আট থেকে দশ বছর অন্যান্য দিকগুলো খুব সীমিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ সেই সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি আবার মানুষ হিসেবে আমার ভালোলাগাগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলাম। তবে আমি ঠিক করেছিলাম রাত এগারোটা পর্যন্ত কোন সময়ই চেম্বার খোলা রাখব না। খোলা রাখলে অর্থনৈতিক ভাবে হয়ত কিছুটা লাভ হত। কিন্তু তাতে নিজেকে সময় দেওয়াটা হয়ে উঠবে না। ফটোগ্রাফার বন্ধুর সাথে আড্ডা হবে না। হবে না কোনো ছবির স্ক্রিপ্ট শোনা। কবিতা লেখার কথা ভাবতেও পারব না। আসলে অর্থনৈতিক চাহিদার তো শেষ নেই। তাই চাহিদাকে যদি আটকানো যায়… মানে আমি সেই কাজটা করেছি। আমার যারা রোল মডেল তাঁদেরকেও দেখেছি এই কাজটা করতে। আবার কেউ করেওনি। কিন্তু আমাদের থেকে যারা দশ-পনেরো বছর বড়, তাঁদের মধ্যে অনেক রকম সাংস্কৃতিক চেতনা ছিল। তাঁরা কিন্তু ৫৫-৬০ বছরে গিয়ে আক্ষেপ করেছেন, সারা জীবন শুধু টাকার পেছনেই দৌড়ালাম। প্রতিষ্ঠার পেছনে দৌড়ালাম। মোদ্দা ব্যাপারটা হল, চল্লিশ পেড়োতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার চাহিদার তো সবটাই পেয়েছি। তাই ইনকাম নয়, বরং সম্ভাবনার দিকে নজর দেয়াটা প্রয়োজন। খুব শান্তভাবে…
প্রফেশনালিজম আপনার কাছে কী?
চিকিৎসার মতন ছবি তোলা, কবিতা, অভিনয় আমার কাছে নেশা এবং পেশা। আমার বন্ধু কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় একদিন হঠাৎ আমায় বলল, কাল থেকে আর ডাক্তারি করব না। ছেড়ে দিলাম। তখন আমি ওকে বলেছিলাম, চিকিৎসা করা তো কোনো চাকরি নয়। এটা একটা ধর্ম। তো তুই হঠাৎ এটা ছাড়বি কী করে?
আসলে, যে কাজটা আমি করব সেটা খুব ভালো মত করব। উত্তরোত্তর নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাব। মানে আজ যা ছবি তুলছি সেটা কাল আরেকটু ভালো… আজকের অভিনয় থেকে দুই বছরের পরের অভিনয়ে উত্তরণ হবে। আর এই উত্তরণের ইচ্ছেটার সঙ্গে পরিশ্রমের সহবাস প্রয়োজন। তাহলেই তাকে প্রফেশনালিজম বলা যায়।
চলবে…
(কথোপকথনের পরবর্তি পর্বের জন্য চোখ রাখুন nblive.in -এ)