Nblive পোর্টজিনঃ
আজ ১১ই সেপ্টেম্বর। ১২৫ বছর আগে ১৮৯৩ সালের এই দিনেই আমেরিকার শিকাগো শহরে বসেছিল ধর্ম মহাসভা। আর এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ। শুধু যোগ দেওয়া নয়, রীতিমতো সম্মেলনে উপস্থিত সকলের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সেদিনের যুবক, ভারতের যুগদিশারী বিবেকানন্দ। আজ সেই শিকাগো বক্তৃতার ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটু ফিরে দেখা যাক সেই দিনটিকে।
আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৯৩ সালটিকে ধর্মসম্মেলনের বছর বেছে নেবার কারণ ঐ বছর ছিল কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের ৪০০ বছর পূর্তি। সম্মেলন চলেছিল ১১- ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। শিকাগো শহরের আর্ট ইন্সটিটিউটের কলম্বাস হল। দর্শকাসন কানায় কানায় পূর্ণ। উপস্থিত হয়েছেন বিশ্বের প্রধান দশটি ধর্মের মূল প্রবক্তা ও প্রতিনিধিরা। শ্রোতা ছিলেন কয়েক হাজার। ভারত থেকে সনাতনী হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হয়ে হাজির হলেন এক সন্ন্যাসী।
ধর্ম সম্মেলনের প্রথম দিনের দ্বিতীয়ার্ধে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন সেই তেজদীপ্ত যুবক। ভাষণ দিতে মূল ডায়াসে দাঁড়ালেন। স্থিতধী বিবেকানন্দ সম্বোধন করলেন, “সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা”। শুধু এটুকু বলার সাথে সাথে প্রায় সাত হাজার দর্শক-শ্রোতা ২ মিনিট ধরে করতালি দিয়ে অভিবাদন জানালেন গেরুয়া পোশাকধারী সেই যুবককে । এ যেন ভারতীয় ঐতিহ্যকেই অভিবাদন জানাল সারা বিশ্ব। সেদিন তিনি বললেন- আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গৌরাবান্বিত বোধকরি , যে ধর্ম বিশ্ব জগতকে শিখিয়েছে পরমত -পরধর্মসহিষ্ণুতা ও সার্বজনীন গ্রহিষ্ণুতার আদর্শ। আমরা শুধু সর্বধর্মকে সহ্যই করি না, সর্বধর্মকে সত্য বলে মান্য করি, বিশ্বাস করি। পরক্ষণে তিনি আবার বললেন- আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব বোধ করি , যে জাতি পৃথিবীর সব ধর্মের ও সব জাতির নিপীড়িত ও শরণার্থী মানুষকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে এসেছে। তিনি বললেন- আমি গর্ব অনুভব করছি যে, আমরাই ইহুদীদের খাঁটি বংশধরদের অবশিষ্ট অংশকে বুকে করে রেখেছি। জরাথুস্ট্রের অনুগামী মহান পারসিক জাতির অবশিষ্ট অংশকে যে ধর্মের মানুষ আশ্রয় দিয়েছিল এবং এখন পর্যন্ত যারা তাদের প্রতিপালন করে আসছে, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি।
হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থেকেও সেদিন তিনি দেখালেন যে, হিন্দু ধর্ম কোনও সাম্প্রদায়িক ধর্ম ছিল না। সেদিন তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছিল কিভাবে হিন্দু ধর্ম পরিণতি লাভ করেছে বিশ্বজনীন ধর্মে — তার ধারাবাহিক ইতিহাস। তিনি সেদিন এবং আজীবন দেখিয়েছিলেন নিজের ধর্মের প্রতি সম্পূণ অনুগত থেকেও কিভাবে মানুষ অন্য ধর্মকে মর্যাদা দিতে পারে। একটি ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থেকেও কিভাবে মানুষ বিশ্বজনীন ধর্মের খোলা আঙ্গিনায় নিজেকে প্রসারিত করে দেওয়া যায়।
তিনি সুন্দর উপমা দিয়ে বলেছিলেন -বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু তারা সকলেই একই সমুদ্রে তাদের জমাকৃত জলরাশি ঢেলে দেয়। তেমনি মানুষের জীবনেরও পরম লক্ষ্য সমুদ্ররূপ ঈশ্বরকে পাওয়া। যা আছে নিজের তা উজাড় করে সঁপে দিতে হবে তাঁরই কাছে। তিনি বললেন- হে ভগবান, নিজের নিজের রুচি- বৈচিত্রের জন্য সরল- জটিল নানা পথ দিয়ে যারা চলেছে, তাদের একমাত্র লক্ষ্যস্থল তুমিই।
তাঁর কথায়- যদি কেউ এমন মনে করেন যে, একটি ধর্মের অভ্যুদয় ও অপর ধর্মগুলির দ্বারা ঐক্য আসবে, তবে তাকে আমি বলবো ভাই, এ তোমার দুরাশা। যদি কেউ এমন স্বপ্ন দেখেন যে, অন্যান্য ধর্মগুলি লোপ পাবে আর তাঁর ধর্মই শুধু টিকে থাকবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র। তাঁর জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। আমি তাকেই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি তাঁর মত মানুষের বিরোধিতা সত্ত্বেও শীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকার উপরে লেখা থাকবে, বিবাদ নয়, সহায়তা। বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ। মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি। তিনি বললেন- খ্রিষ্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না, কিংবা হিন্দু বা বৌদ্ধকেও খ্রিষ্টান হতে হবে না। কিন্তু প্রত্যেককেই অন্য ধর্মের ভাবগুলিকে আত্মস্থ করতে হবে এবং নিজের নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী অগ্রসর হতে হতে হবে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে স্বামীজির শিকাগো ভাষণের গুরুত্ব মহান। অত্যন্ত দুঃখের কথা আজ শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের ১২৫ বছর পূর্তি হলেও এখনও আমরা সেদিনের বক্তব্যের নির্যাস আত্মস্থ করতে পারিনি। ধর্মকে নিয়ে যুদ্ধ ও হানাহানির অন্ত নেই। আজও বহু মানুষ তাদের নিজস্ব আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা। যেভাবে আজ বিশ্ব চলছে তাতে আগামী দিনে মানব সমাজ অত্যন্ত বিপন্ন জায়গায় চলে যাবে। বিশ্বের প্রগতিশীল দেশগুলির কাছে যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমা আছে তা ফাটলে সমগ্র মানব সমাজই বিপন্ন হয়ে যাবে। আজ শুধু ধর্ম নয় রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব জায়গাতেই অবক্ষয়ের পদ চিহ্ন স্পষ্ট। আর এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় স্বামীজির ভাবনায় ভাবতে শেখা এবং প্রায়োগিকভাবে তার বাস্তবায়ন করা। আজকের সময়ে তাই স্বামীজির শিকাগো ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। যদি আমরা সকলে তাঁর মতাদর্শকে কাজে লাগিয়ে এ বিশ্বকে আগামীদের জন্য শান্তিপুর্ণভাবে বাসযোগ্য করে যেতে পারি তাহলেই বিবেকানন্দের শিকাগো ধর্মমহা সম্মেলনের ১২৫ বছর উদযাপন সার্থকতা লাভ করবে। আমরা আশাবাদী। তাই শেষে বলি -একদিন ঝড় থেমে যাবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে।