NBlive পোর্টজিনঃ
আসামের বরাক উপত্যকার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী। আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়, যা গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। এই আন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঘটে, সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
প্রেক্ষাপটঃ
১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে হিংসা যখন বড় রূপ নেয়, তখন লক্ষাধিক বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ, বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। ন’জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।
১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
আন্দোলনের সূচনাঃ
বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়।
অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন ।
বরাকের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেন। ২ মে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিলের(১৯৬১) মধ্যে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হলে, ১৯ মে তে তাঁরা ব্যাপক হরতাল করবেন।
১২ মে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল।
১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।
১৯ মে-এর ঘটনা
১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তাঁরা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু দুপুরের পর স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
প্রায় ২:৩০-র সময় ন’জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটে ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালান হয়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাঁদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু’জন পরে মারা যান। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।
ফলশ্রুতিঃ
এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
শহীদ তালিকাঃ
কানাইলাল নিয়োগী
চন্ডীচরণ সূত্রধর
হিতেশ বিশ্বাস
সত্যেন্দ্রকুমার দেব
কুমুদরঞ্জন দাস
সুনীল সরকার
তরণী দেবনাথ
শচীন্দ্র চন্দ্র পাল
বীরেন্দ্র সূত্রধর
সুকোমল পুরকায়স্থ এবং
কমলা ভট্টাচার্য।
এছাড়াও পরবর্তীতে আসামেই বাংলা ভাষার জন্য আরো তিনজন শহীদ হন:
বিজন চক্রবর্তী, জগন্ময় দেব ও
দিব্যেন্দু দাস।
প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
(সূত্র: উইকিপিডিয়া)