রায়গঞ্জে বাবার মৃত্যুশোক বুকে নিয়েই জীবনের খোঁজে পরীক্ষা কেন্দ্রে রোহিত

NBlive রায়গঞ্জঃ মাথার ছাদটা আর নেই ,খবরটা এসেছিল সকালেই। তবু চোয়াল শক্ত। হাসপাতালে এসে বাবার মৃত শরীর ছুঁয়ে শপথ করল ছেলে, সমস্ত শোকতাপকে তিন ঘন্টার জন্য পাশে সরিয়ে রেখে পরীক্ষা সে দেবেই। চরম মানসিক বিপর্যয়কে সামলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাটি দিল রায়গঞ্জের রামকৃষ্ণ বিদ্যাভবনের ছাত্র রোহিত বিশ্বাস। পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে মৃত বাবার সৎকারও করল সে।

এমন সঙ্কটের মুহুর্তকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেকথা জানা ছিল না কিশোর রোহিতের। তবু মনকে অবিচল রেখে যেভাবে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হল সে তা দেখে হতবাক পাড়ার সকলেই। অবাক হয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বরুণবাবু বলেন, “সকাল থেকেই ওর পাশে ছিলাম। আমি দেখলাম, রোহিত নিজেই মনের দিক থেকে ভীষণ শক্ত। তবু ওর পিঠে হাত রেখে বারবার বলেছি, বাবার আত্মার শান্তির জন্য পরীক্ষাটা তোকে দিতেই হবে। ভেঙে পড়েনি। মাথা নেড়ে জানিয়েছে, পরীক্ষা দেবে।”

রোহিতরা তিন ভাই। ছোট দুই ভাইয়ের একজন নবম ও অপরজন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বাড়িতে একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বাবা স্বপনকুমার বিশ্বাস। একটি সমবায় ব্যাঙ্কের অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। তিন মাস ধরে গলায় সংক্রমণ নিয়ে অসুস্থ ছিলেন শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শক্তিনগরের বাসিন্দা স্বপনবাবু। গত শনিবার অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে ভর্তি করা হয় রায়গঞ্জ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। পড়াশোনা সামলেও বাবার পাশে পাশেই থাকতে হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রোহিতকে। এছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। সোমবার সকালে উঠেই বাড়িতে পড়তে বসেছিল সে। আর তখনই মাথায় বজ্রাঘাতের মতো এল সেই খবর। বাবা আর নেই। বইখাতা ফেলে রেখে ছুটে গেল হাসপাতালে। চোখে জল এলেও চোয়াল যেন শক্ত। মৃতদেহ পড়ে রইল হাসপাতালের বেডে। বাড়ি ফিরে কাউন্সিলরের সঙ্গেই সোজা পৌঁছে গেল পরীক্ষাকেন্দ্র গয়ালাল হাই স্কুলে। ভয়ে ভয়ে ছিলেন সকলেই। কিন্তু না, হল থেকে বেরিয়ে রোহিত জানাল, পরীক্ষা ভাল হয়েছে তার।

এদিকে মৃতদেহ নিয়ে রোহিতের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন প্রতিবেশী ও পরিজনরা। বাড়ি ফিরতেই যেন বাঁধ ভাঙল আবেগ। ভাঙাচোরা বাড়ির এক চিলতে উঠোনে তখন কান্নার রোল। নিজেকে সামলাতে পারল না রোহিতও।
শ্মশানে পৌঁছে বাবার মুখাগ্নি করে ছোট্ট দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে চিতাঘরের বাইরে এসে বসল সে। স্থির দুই চোখ। আগামী কাল তো ইংরেজী পরীক্ষা। তুমি কি পরীক্ষা দেবে ? দুই ভাইয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রোহিতের উত্তর, “বাবাকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু আজ থেকে শুধু আমার ভবিষ্যৎ নয়, ভাই দুটোর কথাও তো এখন আমাকেই ভাবতে হবে। তাই আমি চাই না একটা বছর নষ্ট হয়ে যাক। পরীক্ষা দেব।” হাতে কুশাসন নিয়ে আজও সে পৌঁছে গেছে পরীক্ষাকেন্দ্রে। আজ তার ইংরেজী পরীক্ষা যে !

Exit mobile version