বেঙ্গল লাইভ Special

সন্তানের মনোযোগের অভাব ? কী করবেন আপনি ?

আপনার সন্তানের মনোযোগের অভাব নিয়ে কি আপনি চিন্তিত ? মাত্র সাতটি পদক্ষেপ নিতে পারেন তাকে মনোযোগী করতে। লিখেছেন অমিতাভ দাষ৷

Bengal Live স্পেশালঃ বর্তমান সময়ের বাবা-মাদের সবচেয়ে সাধারণ অভিযোগ তাদের সন্তানের মনোযোগের অভাব।অনেকেই জানান তাদের সন্তান সম্পর্কে।কেউ সন্তান নিয়ে বেশি চিন্তিত,কেউ বা কম।কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সবচেয়ে কমন চিন্তা, মনোযোগের অভাব সম্পর্কিত।

সেদিন এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হল।তার মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে।স্কুল বন্ধ,অনলাইনে ক্লাস চলছে।বন্ধুর মেয়ে বন্ধুর ল্যাপটপে ক্লাস করতে করতে গ্লাসে দুধ খাচ্ছিল।গোটা গ্লাস উল্টে সব দুধ ল্যাপটপকে খাইয়ে দিয়েছে। সত্তর হাজার টাকার মেশিন গরুর দুধ সহ্য করতে পারেনি।খারাপ হয়ে গিয়েছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম সে কি সবদিনই ক্লাস করতে করতে খায়?বন্ধু জানালো যে সময় বাঁচাতে ক্লাস করতে করতে খাওয়ার অভ্যাস করানো হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ আপনার সন্তান কী সফল ভবিষ্যৎ পাবে? এখনই বুঝবেন কীভাবে?

এই যে একসঙ্গে দুইটি বা তিনটি কাজ করা, যাকে আমরা মাল্টিটাস্কিং বলি ,তা অত্যাধুনিক সময়ের একটা সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমরা টিভিতে খবর শুনতে শুনতে মোবাইলে ফেসবুক চ্যাট করছি, টেবিলে ভাত খেতে খেতে হোয়াটসআপ খুলে ছবি ফরওয়ার্ড করছি, সন্তানকে পড়তে বসিয়ে ফোন করছি,বা রাতে আড্ডা দেবার সময় কোনো বন্ধুর সমস্যা শুনতে শুনতে কোনো প্রোডাক্ট খুঁজছি ফ্লিপকার্ট বা আমাজনে। এগুলোই খুব সহজভাবে মাল্টিটাস্কিং এর উদাহরণ।

আমরা ভেবেছি যে এইভাবে একই সময়ে দুই বা তিনটি কাজ একসঙ্গে করলে অনেক সময় বাঁচানো সম্ভব। আমরা সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও শেখাচ্ছি। তারা খেতে খেতে কার্টুন দেখছে। গান শুনতে শুনতে ছবি আঁকছে। অংক করতে করতে টিফিন খাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, নিউরোসায়েন্স বলে আমাদের মস্তিষ্ক একটি সময়ে শুধুমাত্র একটি বিষয়েই মনোনিবেশ করতে পারে। আমরা যতই মাল্টিটাস্কিং করার চেষ্টা করি, মনোযোগ কিন্তু দ্বি বা ত্রি খণ্ডিত হয়ে কাজ করতে পারে না। তার ফল আমাদের শর্ট- টার্ম স্মৃতিতে, ( যা অনেকটা কম্পিউটার বা মোবাইলে RAM এর মত) কোনো কাজই দাগ কাটতে পারে না। ফলে লং-টার্ম মেমোরিতেও সেই কাজের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা ঠিকঠাক সঞ্চিত হয় না।সময় ও শ্রম, সবটুকুই, এককথায় জলে চলে যায়।

মন বা চিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন? স্বামী বিবেকানন্দের “রাজ যোগ” পড়লে পাবেন যে শাস্ত্রে মনকে তুলনা করা হয়েছে এক বাঁদরের সাথে। কেমন বাঁদর? সে এক অস্থির মতি বাঁদর।এমনিতেই বাঁদর চঞ্চল হয়। কিন্তু মন-বাঁদর আবার সুরা পান করে হয়েছে আরও অস্থির। শুধু তাই নয়,তাকে আবার এক কাঁকড়াবিছে কামড়েছে। সে আরও অস্থির হয়ে উঠেছে।এতেও শেষ নয়।তার মধ্যে ঢুকে গেছে এক অশুভ আত্মা। ভাবুন এবার বাঁদরটির অবস্থা।

আরও পড়ুনঃ পরীক্ষায় তো নম্বরের বন্যা, কিন্তু জীবন বইবে কোন খাতে ? পড়ুন, ভাবতে সাহায্য করবে

মনের অবস্থাও স্বভাবত তেমনি।সে জন্মগতভাবে অস্থির।তার ওপর সে কামনা -বাসনার সূরা পান করেছে।আমার এই চাই।ওই চাই। তার ওপর তাকে কামড়েছে হিংসা ও লোভের কাঁকড়াবিছে। ওর আছে,আমার নেই কেন? সে পায় ,আমি পাইনা কেন? এতেও শেষ নয়, অহংকারের বা আমিত্ব এর ভূত ঢুকেছে তার মধ্যে। সে ভাবছে আমি চাইলে সব পারি। আমি যা বুঝি,যা বলি সবই ঠিক। সব মিলিয়ে মনের বাঁদর পাগলের মত অস্থির হয়ে আছে এমনিতেই।আমরা আবার তাকে দিয়ে করাচ্ছি মাল্টিটাস্কিং। ভাবুন, আপনার মন যে বেঁচে আছে, এই ঢের বেশি।

বাবা-মা দের জ্ঞান দেওয়ার স্পর্ধা আমার নেই।সবাই আমার থেকে অনেক বেশিই বোঝেন। তবে যারা তাদের বাচ্চাদের মনোযোগ নিয়ে চিন্তিত, তাদের বলছি, যত দ্রুত সম্ভব, আপনার সন্তানের একাগ্রতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিন। মনোযোগহীনতা যদি অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়, একটা বয়সের পর,সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে তা ঠিক করা ভীষণ শক্ত হয়ে যায়।

কতকগুলি সাধারণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে প্রাথমিকভাবে ,যাতে মনোযোগের অভ্যাস তৈরি করা যায়।

প্রথমত: সন্তানকে আজ থেকেই একই সময়ে দুটি কাজ করা থেকে বিরত করুন, তা সে যতই তুচ্ছ কাজ হোক না কেন।

দ্বিতীয়ত: নিজেরাও ,অন্তত:, সন্তানদের সামনে দুটি কাজ একসঙ্গে করবেন না। আস্তে আস্তে অভ্যাস করুন।আপনি ভাবছেন আপনি সময় বাঁচাচ্ছেন, কিন্তু আসলে তা কিন্তু হচ্ছে না।

তৃতীয়ত: সন্তানকে কখনোই বলবেন না, সে অমনোযোগী, তার মনোযোগ নেই। এই কথাগুলি বারবার বললে তার মস্তিষ্কে তা গেঁথে যাবে। তাকে বলুন, “ তুমি খুব মনোযোগী, কিন্তু দুটো জিনিস একসঙ্গে করলে মনোযোগ নষ্ট হয়, তোমাকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।“

চতুর্থত : আপনার সন্তান আপনাকে কোনো কিছু বলতে চাইলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে শুনুন। তাকেও শেখান, কেউ কিছু বললে ,বক্তার দিকে তাকিয়ে তা শুনতে হয়।

পঞ্চমত: তাকে কল্পনা করতে হয়, এমন খেলাগুলোতে উৎসাহ দিন।ছবি আঁকা, কাগজ ভাঁজ করে কিছু বানানো,পুতুল খেলা, পুতুলের জিনিস বানানো, মাটি ও অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করে কিছু তৈরি করা ইত্যাদি।

ষষ্ঠত: ওকে ওর বই,খাতা, পেন-পেন্সিল,জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখতে উৎসাহিত করুন।মনে রাখবেন,ছোট ছোট কাজ নিখুঁতভাবে করা মনোযোগের অভ্যাসের প্রাথমিক হাতেখড়ি।এগুলো তুচ্ছ ব্যাপার নয়। একটি একাগ্র চরিত্র তৈরি করতে এগুলো খুব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

সপ্তমত: তার মনোযোগ একটু একটু করে বাড়লে, তাকে ধ্যান করতে সেখান। এমন কিছু নয়। যেকোনো বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে চিন্তা করার নামই আসলে ধ্যান। প্রথম পর্যায়ে দেয়ালে একটা বিন্দু একে তাতে মনোনিবেশ করা যেতে পারে। আরো অনেক পদ্ধতি আছে। পরবর্তীতে সেগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা যাবে।

আরও পড়ুনঃ ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির পথ, জেনে নিন বিশেষজ্ঞর পরামর্শ

মনে রাখবেন, মনোযোগ বাড়ানোর পথ সোজা, কিন্তু এর নির্দিষ্ট ধাপগুলো আপনাকে পেরোতে হবে।আপনার দেখানো পথেই কিন্তু আপনার সন্তান চলে, তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতেই হবে, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য।

একাগ্রতা থাকলে জীবনের যে কোনো লক্ষ্য পাওয়া খুব সোজা হয়ে যায়।আর মনোযোগ বা একাগ্রতা কোনো জন্মগত গুন নয়,অভ্যাসগত গুন। তাই আপনার সন্তান যত একাগ্র হবে,ততই সে এগোতে পারবে নিজের লক্ষ্যে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে। তবে তার জন্য আপনাকে একটু যত্ন নিতে হবে।ঠিক যেমনভাবে যত্ন নেন তার শরীরের, তার পড়াশুনোর, তার খাওয়াদাওয়ার, তেমনিভাবে তার মনোযোগ বিকশিত করার দায়ও কিন্তু আপনার।

অমিতাভ দাষ।
Child and adolescent counsellor; depression counsellor; psychotherapist.

Back to top button